দেশে প্রতি বছর চার লাখেরও বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। এর মধ্যে ২৪ শতাংশই বিষধর। এসব সাপের কামড়ে বছরে মারা যাচ্ছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ। বিষধর এসব সাপের কামড়ে ভুক্তভোগীরা প্রতিষেধক নিলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা কার্যকর হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বিষধর সাপে কামড়ানো রোগীকে দেয়া অ্যান্টিভেনমের (প্রতিষেধক) কার্যকারিতা সব ক্ষেত্রে নেই। তাদের ভাষ্যে, দেশে মাত্র তিন প্রজাতির তিনটি সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় প্রতিষেধক কার্যকর।
অসংক্রামক রোগ নিয়ে গত মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বছরে লাখে ২৪৪ জন বিষধর সাপের কামড়ের শিকার হয়। এর মধ্যে মারা যায় চার-পাঁচজন। সে হিসাবে প্রতি বছর চার লাখের বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে মারা যায় প্রায় ৭ হাজার ৫১১ জন। সাপের কামড়ানো এসব মানুষের ৯৫ ভাগই গ্রামের। ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন অ্যানুয়াল ইনসিডেন্স অ্যান্ড ইপিডোমিওলজি অব স্নেকবাইট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় স্বাস্থ্য অধিপ্তরের ‘এনসিডিসি রিসার্চ ইনফোগ্রাফিকস’ নামের জার্নালটিতে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতি বছর সাপের বিষের যে প্রতিষেধকটি প্রয়োগ করা হচ্ছে তা আমদানি করা হচ্ছে পাশের দেশ ভারত থেকে। এ মুহূর্তে বিষধর সাপে কামড়ানোর অ্যান্টিভেনম আমদানির অন্য কোনো দেশ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তালিকায় নেই। প্রতিষেধকটি সরকারের অনুমোদিত বেসরকারি একটি ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান আমদানি করছে। তারাই মূলত দেশে প্রতিষেধকটি বোতলজাত ও বিপণন করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে জানান, ভারত থেকে আনা অ্যান্টিভেনম কিছু সাপের বিষের ক্ষেত্রে কার্যকর। সব বিষধর সাপের কামড়ানোর চিকিৎসায় এ প্রতিষেক যথেষ্ট নয়। প্রতিটি সাপের জন্য আলাদা অ্যান্টিভেনম প্রয়োজন। এজন্য ভেনম রিসার্চ সেন্টারের মাধ্যমে বিষ সংগ্রহ করা গেলে তা দিয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা যেতে পারে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে কিং কোবরা (গোখরা), ক্রেইট (শঙ্খিনী) ও রাসেলস ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) এ তিনটি (তিন প্রজাতির তিনটি) সাপের বিষের প্রতিষেধক ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে কাজ করছে। বাকি বিষধর সাপের ক্ষেত্রে এ অ্যান্টিভেনমের কার্যকারিতা নেই। ফলে অনেক বিষধর সাপের কামড়ে ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রে প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানভিত্তিক তথ্যসেবা দাতা প্রতিষ্ঠান প্রকুইস্টে প্রকাশিত বাংলাদেশী এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৮২ প্রজাতির সাপ রয়েছে। যার মধ্যে ২৮ প্রজাতি বিষধর। এসব সাপে কামড়ালে একমাত্র প্রতিষেধক অ্যান্টিভেনম। এ অ্যান্টিভেনমের কার্যকারিতা শুধু রাসেল ভাইপার, কোবরা ও ক্রেইটের ক্ষেত্রে। সামুদ্রিক সাপ ও পিট ভাইপার ও দুর্লভ ক্রেইটসহ অন্যান্য বিষধর সাপের বিষের ক্ষেত্রে এ অ্যান্টিভেনম অকার্যকর। ফলে বিষধর অন্য সাপের কামড়ের শিকার ভুক্তভোগীদের অনেকেই মারা যাচ্ছে।
তার এ গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রত্যেকটি সাপের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনমের পরিমাণ ও কৌশল ভিন্ন ভিন্ন। বিশেষত একটি গোখরার কামড়ে একজন ভুক্তভোগীর শরীরে ১০০-২০০ মিলিলিটার অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হয়। শঙ্খিনীর ক্ষেত্রে তা ৩০০-৪০০ মিলিলিটার ও চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে ১০০-৮০০ মিলিলিটার।
দেশে বিষক্রিয়া ও জনসচেনতা তৈরিতে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটি বলছে, বাংলাদেশে আমদানীকৃত অ্যান্টিভেনম মূলত চার প্রজাতির সাপের বিষের মিশ্রণ। এ মিশ্রণ হাতেগোনা কয়েকটি সাপের কাটার চিকিৎসায় কার্যকর। তাদের মতে, চন্দ্রবোড়া সাপের ক্ষেত্রেও এ অ্যান্টিভেনম তেমন কার্যকর নয়।
দেশে বিভিন্ন গবেষণায় ও তথ্যে উঠে এসেছে, সাপে কাটা রোগীদের বেশির ভাগই শুরুতেই গ্রাম্য চিকিৎসক, ওঝা ও কবিরাজের কাছে যায়। পরে যখন হাসপাতালে যায়, তখন বিষের অ্যান্টিভেনমের অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকারিতা থাকে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, সাপের কামড়ের বিষক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা অপর্যাপ্ত। অনেক ভুক্তভোগী প্রথাগত চিকিৎসার ওপর নির্ভর করেন। বছরে সারা বিশ্বে প্রায় ৫৮ লাখ মানুষকে সাপে কাটছে। মারা যাচ্ছে দেড় লাখ। ২৭ লাখের মধ্যে দেখা দিচ্ছে শারীরিক জটিলতা। বিভিন্ন দেশের সাপের প্রকৃতি ও বিষের ভিন্নতা হওয়ায় চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি অপরিহার্য।
জানা যায়, ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ‘ভেনম রিসার্চ সেন্টার’ নামে প্রকল্প চালু করে। অধিদপ্তরের আর্থিক সহায়তায় অ্যান্টিভেনম গবেষণা ও তৈরির প্রকল্পটিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটি ও জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা যুক্ত রয়েছেন।
ভেনম সেন্টারের প্রধান গবেষক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জানিয়েছেন, দেশে যত বিষধর সাপ রয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করার লক্ষ্য রয়েছে। ক্রেইটের মধ্যে বাংলাদেশে ছিল কমন ক্রেইট। তবে ব্ল্যাক ক্রেইট, বাঙ্গারাস রয়েছে এমন তথ্য আগে ছিল না। বাংলাদেশে কিং কোবরা, কোবরার প্রজাতি নায়া কাউচিয়া, পাঁচ প্রজাতির ক্রেইট, রাসেল ভাইপার, পিট ভাইপারসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে। এর মধ্যে কিং কোবরা, ক্রেইট, রাসেল ভাইপার সংগ্রহ করা হয়েছে। ভৌগোলিক কারণে এসব সাপের বিষের পার্থক্য থাকতে পারে। আবার সাপের ছোটবেলা থেকে বড় বেলায় বিষের ভিন্নতা থাকতে পারে।’ তিনি আরো জানান, ভেনম সেন্টারের সংগ্রহে ৩৫০ মতো সাপ আছে। সামুদ্রিক সাপ খুবই বিষধর। তবে দেশে সামুদ্রিক সাপ থাকলেও তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয় না। সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম রয়েছে, তবে তা অপ্রতুল।
দেশে সাপের কামড়ের বিষয়টি কম গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ ফায়েজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর সারা দেশে বহু মানুষ সাপে কামড়ের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে। সাপের কামড় প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ব্যবস্থা প্রয়োজন। সাপে কামড়ের শিকার হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে যেতে হবে।’