সিংহভাগই অকার্যকর: ২১টি ট্রমা সেন্টার নির্মাণের পর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার

সারা দেশে আঞ্চলিক ও মহাসড়কের মধ্যে দুর্ঘটনাপ্রবণ অংশে ট্রমা সেন্টার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। প্রায় দুই দশক আগে নেয়া সিদ্ধান্তের আলোকে এরই মধ্যে ২১টি সেন্টার নির্মাণ শেষ হয়েছে। তবে এসব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগই চালু করা যায়নি। সেন্টারগুলোর উদ্বোধন করা হলেও দেয়া হয়নি জনবল নিয়োগ, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম। প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণের পর পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আলাদা করে আঞ্চলিকভাবে ট্রমা সেন্টার কার্যকর নয়। সেজন্য নতুন করে আর কোনো ট্রমা সেন্টার নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

২০১৮ সালে বগুড়ার শেরপুরে ট্রমা সেন্টারের নির্মাণ শেষ হয়। এতে ব্যয় হয় ১৪ কোটি টাকা। চারতলা ভবনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরও করা হয়। তবে চালু হয়নি রোগী ভর্তি ও বহির্বিভাগ। একইভাবে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, হাটহাজারী ও রাউজানে তিনটি ট্রমা সেন্টারের উদ্বোধন হয় যথাক্রমে ২০১৩, ২০২১ ও ২০২৩ সালে। অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর অনুপযোগিতা, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলের অভাবে তিনটির কোনোটিতেই চিকিৎসা কার্যক্রম চালু করা যায়নি।

শুধু বগুড়ার একটি বা চট্টগ্রামের তিন ট্রমা সেন্টারই অকার্যকর নয়। সারা দেশে নির্মিত ২১টির মধ্যে প্রায় সবগুলোতেই পরিপূর্ণ চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়নি। এর কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চিকিৎসকের পদ তৈরি না করতে পারায় এসব সেন্টার বলতে এখন শুধু ভবনই রয়েছে। যদিও সেন্টারের ভবন ও জনবলের পদায়ন বা নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্গানোগ্রাম একই সঙ্গে তৈরি হওয়ার কথা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনায় আহতদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিতে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে সরকার ট্রমা সেন্টার চালুর উদ্যোগ নেয়। ওই সময় ১০টি ও ২০১০ সালে আরো ১১টি সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ২০ শয্যার কেন্দ্রগুলোয় সার্বক্ষণিক সাতজন কনসালট্যান্ট বা পরামর্শক চিকিৎসক, তিনজন অর্থোপেডিক সার্জন, দুজন করে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) এবং ১০ জন নার্স নিয়োগ দেয়ার কথা। এছাড়া ফার্মাসিস্ট, রেডিও ও ল্যাব টেকনিশিয়ান, গাড়িচালক, অফিস সহকারী, ওয়ার্ড বয়, আয়া ও ল্যাব অ্যাটেনডেন্টসহ থাকার কথা আরো ৩৪টি পদ।

মূলত লোকবল না থাকা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের ওপর অত্যধিক চাপ এবং চিকিৎসা যন্ত্রাংশের অভাবে ট্রমা সেন্টারগুলো চালু করা যায়নি বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ২১টির মধ্যে ১৯টি উদ্বোধন হয়েছে। এর মধ্যে দুটিতে বহির্বিভাগ চালু করা হয়েছে। তবে নতুন করে আর কোনো ট্রমা সেন্টার তৈরি করবে না স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। কেননা বাংলাদেশের জন্য ট্রমা সেন্টারের বাস্তবায়ন কঠিন। এর পরিবর্তে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় অর্থোপেডিক ইউনিট চালু করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ট্রমা সেন্টারগুলো যখন করা হয়েছিল তখন জনবলেরও পরিকল্পনা করা হয়। তবে সেন্টারগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলেও পদ সৃষ্টি হয়নি। আমরা সম্প্রতি জনবলের অর্গানোগ্রাম তৈরি করেছি। এতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও অনুমোদন দিয়েছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে তা মন্ত্রিসভায় যাবে। সেখানে অনুমোদনের পর আবার অর্থ মন্ত্রণালয় হয়ে অর্থ বরাদ্দ হবে। তখন আমরা জনবল নিয়োগ ও পদায়ন করতে পারব।’

নতুন করে আর ট্রমা সেন্টার তৈরি করা হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেগুলো নির্মাণ হয়েছে সেগুলো চালু করার চেষ্টা চলছে। আর নতুন করে কোনো ট্রমা সেন্টার তৈরি করা হবে না। কেননা দুর্ঘটনায় আহতদের শুধু অর্থোপেডিক নয়, প্রয়োজন সমন্বিত চিকিৎসা। যা একটি ট্রমা সেন্টারে থাকে না। ফলে উপজেলা হাসপাতালগুলোয় অর্থোপেডিক বিভাগ চালু করা হচ্ছে। যেখানে সার্জন থেকে শুরু করে যেসব লোকবল প্রয়োজন তা দেয়া হবে। সেখানেও যদি রোগীর চিকিৎসা পরিপূর্ণ না হয় তখন তাকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হবে। দেশের সব জেলা হাসপাতাল এরই মধ্যে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। আইসিইউর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে একটি শক্তিশালী অর্থোপেডিক ইউনিট চালু করা হচ্ছে। এর পরও রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব না হলে প্রয়োজন অনুসারে বিভাগ ও রাজধানীর বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) হাসপাতালে পাঠানো হবে।’

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পাবনার আটঘরিয়া, বগুড়ার শেরপুর, সিরাজগঞ্জের সদর ও উল্লাপাড়া, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, গোপালগঞ্জের সদর, মাদারীপুরের শিবচর, মানিকগঞ্জের শিবালয়, শরীয়তপুরের জাজিরা, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, ঢাকার ধামরাই, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, হাটহাজারী ও রাউজান, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ফেনীর মহিপাল, ময়মনসিংহের ভালুকা, সুনামগঞ্জের ছাতক এবং হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় ২১টি ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে গত বছর প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১৫ জনের বেশি মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। ‘ট্রমা কেয়ার সিনারিওস ফলোয়িং রোড ট্রাফিক ক্লাশেস ইন বাংলাদেশ: এ স্কোপিং রিভিউ’ শিরোনামের ওই গবেষণায় বলা হয়, প্রতিদিন প্রায় পৌনে ২ হাজার মানুষ বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। এর মধ্যে প্রতিদিন স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে ২৯ জন। হাসপাতালে মোট শয্যার ৩৩ শতাংশই ভর্তি হয় এসব রোগী। যার মধ্যে ১৯ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৪ হাজার ৩৭১ এবং আহত ৩ হাজার ৭০২ জন। যদিও সরকারি এ হিসাবের বাইরে আহত ও নিহতের আরো বেশি ঘটনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

যাত্রাবাড়ী-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা দিতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধন করা হয় মাদারীপুরের শিবচরের ট্রমা সেন্টার। প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তিনতলাবিশিষ্ট সেন্টারটি অব্যবহৃত পড়ে আছে। এ বিষয়ে মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মুনীর আহম্মেদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কেন্দ্রটি চালু করার জন্য এখনো জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। যে কারণে আধুনিক এ ট্রমা সেন্টার চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।’

গোপালগঞ্জ সদরে ট্রমা সেন্টার নির্মাণ শেষ হয় ২০১৮ সালে। কেন্দ্রটির অবস্থাও একই। এখনো চালু হয়নি। জেলা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ জানিয়েছে, জনবল নিয়োগের পর সেবা কার্যক্রম শুরু করা যাবে। সরজমিনে দেখা যায়, সেন্টারের ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। কমপ্লেক্সের ভেতরে দিনে গরু-ছাগলের আশ্রয় আর রাতে মাদকাসক্তদের আসর বসে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত ৩ ডিসেম্বর ট্রমা সেন্টারের বহির্বিভাগ চালু করা হয়। সেন্টারটি পরিপূর্ণভাবে চালুর জন্য জনবল নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।’

১৬ বছর আগে ২০০৭ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় উদ্বোধন করা হয় ২০ শয্যার ট্রমা সেন্টার। জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকটে এর কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাসানুল হোসেন জানান, রোগী ভর্তির ব্যবস্থা করা গেলে অস্ত্রোপচার শুরু হবে।

অভিযোগ রয়েছে, সেন্টারগুলো উদ্বোধনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বেশ আগ্রহ থাকলেও কার্যক্রম চালুর ব্যাপারে সেটি কম। প্রায় তিন বছর কভিড ও ডেঙ্গু সামাল দিতেই সময় চলে গেছে বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ট্রমার চিকিৎসা জরুরি চিকিৎসা। সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ কাজ করে। তারা স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য ব্যস্ত থাকে। ট্রমা সেন্টার চালু করতে হলে আলাদা লোকবল প্রয়োজন। ট্রমা সেন্টারের ধারণা ভালো হলেও বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। নতুন করে আর কোনো ট্রমা সেন্টার তৈরি করা হবে না। তবে যেগুলো করা হয়েছে সেগুলো চালু করার চেষ্টা চলছে।’

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুর্ঘটনায় শিকার ব্যক্তিদের শুধু অর্থোপেডিক চিকিৎসা প্রয়োজন হয় এমন নয়। তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, স্নায়বিক সমস্যা হতে পারে। এজন্য সমন্বিত চিকিৎসা দরকার।

বাংলাদেশে কোনো স্থাপনার ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে কোনো কিছুই নির্মাণ বা স্থাপনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলো চিন্তা করা হয় না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনায় সবকিছুই হয়, তা ভালো হোক বা মন্দ। দুর্ঘটনায় আহতদের সব বিষয়ের চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। ট্রমা সেন্টারগুলো সেই চিকিৎসা দিতে পারবে কিনা তা আগেই ভাবার প্রয়োজন ছিল। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এগুলোকে ফেলে রাখলে চলবে না। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সেন্টারগুলোকে জরুরি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ কেউ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এলে তাকে দ্রুত ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে অন্য উচ্চ সক্ষমতার হাসপাতালে পাঠাতে হবে। এর জন্য ভালো অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অক্সিজেন থাকতে হবে। যাতে দ্রুত রোগীকে অক্সিজেন দেয়া যায়।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ব্যুরো, বগুড়া, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা ও ময়মনসিংহ প্রতিনিধি)

Source: Bonik Barta

Share the Post: