প্রযুক্তির উত্কর্ষে মানুষের জীবনযাপন এখন অনেক সহজ। তবে প্রযুক্তি কেবল জীবন সহজই করেনি, করেছে নিয়ন্ত্রণহীনও। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বায়ু, পানি বা শব্দদূষণের মতো সমস্যা। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনে। এর ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশে গত ১০ বছরে বেড়েছে শ্বাসতন্ত্র ও ডায়াবেটিসে মৃত্যুর হার। দুটি সমস্যারই মূল কারণ অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও দূষণ। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থায় রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা ও জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা না গেলে এসব রোগে মৃত্যুহার ক্রমেই বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন (আইএইচএমই) বলছে, বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রোগে মৃত্যুহারে পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে জীবনযাপনের সঙ্গে যে রোগগুলোর সম্পর্ক রয়েছে, সেগুলোর পরিমাণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেড়েছে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি ও ডায়াবেটিস।
সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে যে ১০ রোগে মৃত্যুহার বেশি ছিল তার মধ্যে ৯ নম্বরে ছিল ডায়াবেটিস। সে সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে রোগটি ৬ নম্বরে চলে আসে। সে সময় মৃত্যুহার বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ। একইভাবে ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ মৃত্যুহারের তালিকায় সিওপিডির অবস্থান ৫ নম্বরে থাকলেও তা ২০১৯ সালে ৩-এ উঠে এসেছে। ১০ বছর আগে এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু ২০১৯ সালে সিওপিডিতে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গিয়েছেন ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ রোগী।
সিওপিডি বা ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ হলো ধূমপান, কাঠের চুলার ধোঁয়া, ধুলাযুক্ত পরিবেশে দীর্ঘদিন কাজ করার বিরূপ প্রভাব। তবে কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণও দায়ী। সিওপিডিতে মূলত শ্বাসনালির ভেতরের গ্রন্থিগুলো মাত্রাতিরিক্ত শ্লেষ্মা তৈরি করে শ্বাসনালিকে সংকুচিত করে। ফলে ফুসফুসের ভেতর থেকে বাতাস শ্বাসের সঙ্গে বের হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে ফুসফুসের কিছু অংশ ধ্বংসও হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে মোট মৃত্যুর তৃতীয় কারণ হলো সিওপিডি। ২০১৯ সালে সিওপিডিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর ৯০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। যাদের বয়স আবার ৭০ বছরের নিচে। প্রাথমিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা, ধূমপান ত্যাগ এবং দূষিত পরিবেশ থেকে দূরে থাকলে সিওপিডির ঝুঁকি কম থাকে। মূলত তামাকের ধোঁয়া, অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ-ধূলিদূষণ, ধোঁয়া ও রাসায়নিকের ফলে পরিবেশের বৈরিতা সিওপিডির ঝুঁকি বাড়ায়। ক্ষতিকারক গ্যাস ও কণার দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় থেকে সিওপিডি হয়, যা শৈশব ও বংশগতভাবে ফুসফুসের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে।
বাংলাদেশে সিওপিডিতে আক্রান্তের বিষয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশ পায়। ‘প্রিভিলেন্স অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস অব ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৩ শতাংশ সিওপিডিতে ভুগছেন। তামাক ব্যবহারকারী, বায়োগ্যাস (এক ধরনের জৈব গ্যাস) জ্বালানি ব্যবহারকারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে এ প্রকোপ অনেক বেশি।
আমেরিকান থোরাসিক সোসাইটি (এটিএস) ও ডব্লিউএইচও বলছে, ২১ শতকে সিওপিডি একটি বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ২০০৫ সালে বিশ্বে ৫ শতাংশ মৃত্যুর কারণ সিওপিডি। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সিওপিডিতে মৃত্যুর হার অন্তত ১১ শতাংশ বেড়েছে। একই সময় এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪ শতাংশ।
বায়ুদূষণ ও ধূমপান সিওপিডির মূল কারণ বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সিওপিডি হলো নিঃশ্বাসে বাধাজনিত রোগ। ধূমপায়ীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান করলে সিওপিডির ঝুঁকি তৈরি হয়। একই সঙ্গে বায়ুদূষণ, খড়ি দিয়ে রান্নাসহ বিভিন্ন দূষণের কারণে সিওপিডি হতে পারে। বিশ্বে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। আরো বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে মৃত্যুহার ত্বরান্বিত হচ্ছে।
এদিকে প্রতি বছর মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণযোগ্য কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এ রোগের ফলে অকালমৃত্যুর হারও বেড়েছে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, কম কায়িক পরিশ্রম, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসসহ জীবনযাপনে কোনো ধরনের অসামঞ্জস্যতা থাকলে এ রোগ বাড়ে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে পৃথিবীতে ৪৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশে আক্রান্ত ছিল ৮৪ লাখ মানুষ। ২০৪৫ সালে বাংলাদেশে এ সংখ্যা দেড় কোটি ও বিশ্বে ৭০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তবে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ২০২১ সালে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৩১ লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ দুই বছরে ৫৬ শতাংশ রোগী বেড়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের এক জরিপে বলা হয়, ২০১৮ সালে দেশে মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। এক বছর পর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির জরিপে তা আড়াই গুণ বাড়ে। ওই সময় দেশের ৪২৬টি উপজেলার এক লাখ জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত জরিপে ২০ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস রয়েছে বলে উঠে আসে।
ডব্লিউএইচও বলছে, ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারী। এটি এমন একটি রোগ, যা কখনো ভালো হয় না। কিন্তু জীবনযাপনে পরিবর্তন এনে এ রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির বিশ্ব স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রের সমন্বয়ক ডা. বিশ্বজিৎ ভৌমিক। তিনি বলেন, মূলত কায়িক পরিশ্রমের মাত্রা কমে যাওয়া, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও মানসিক চাপ বা বিষণ্নতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা সবচেয়ে বেশি মারা যান হূদরোগে। আর টাইপ-১ ডায়াবেটিসে মারা যান কিডনি অকেজো হয়ে। বংশগতভাবে আমাদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এর সঙ্গে বাংলাদেশে অতিদ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে যা অপরিকল্পিত। এতে আমাদের বিনোদন, হাঁটার স্থানসহ নানা সামাজিক কার্যক্রম কমে যাচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে আমাদের শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি দেখা দিচ্ছে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, অপর্যাপ্ত ঘুম, অপুষ্টি, ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির কারণে আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। এগুলো সবই ডায়াবেটিসের কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিসের কারণে হূদরোগ, কিডনি রোগ, চোখের রোগ, স্নায়ু রোগ, গর্ভকালীন জটিলতার সৃষ্টি হয়। এতে অকালমৃত্যুর হার বাড়ছে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ডায়াবেটিস রোগী নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রতিরোধযোগ্য এ অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রয়েছে। তবে কেউ একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে আজীবন তাকে তা বহন করতে হয়। আগে থেকেই সতর্ক হলে ডায়াবেটিস এড়ানোও যায়।
দূষণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কমেছে। দেশের রোগীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত। অন্যদিকে অসংক্রামক রোগ ৭০ শতাংশ। বায়ুদূষণ যত বাড়ে সিওপিডি আক্রান্তের পরিমাণও তত বাড়ে। এর কারণে মৃত্যুও বাড়ে। কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে ঢাকা শহর বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। বায়ুদূষণ না থাকলে সিওপিডি বাড়ত না। দূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক রয়েছে। আধুনিক জীবনের নানা জটিলতা মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। দূষণের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকাজে রাসায়নিকের ব্যবহার, ফলমূলে কীটনাশকের ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এসব বিষয় সিওপিডি ও ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।