মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ অংশ দেহের চলাচল ও নড়াচড়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আঘাতসহ বিভিন্ন কারণে মায়ের গর্ভে, শিশুর জন্ম-পরবর্তী সময়ে বা খুব অল্প বয়সে মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক বিকাশ কিংবা বিকাশমান মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। মস্তিষ্কের এসব ক্ষতিগ্রস্ত অংশ শরীরের বিভিন্ন পেশিকে ভুল সংকেত পাঠায়। আর এ ভুল সংকেতের কারণে পেশিগুলো অত্যন্ত দৃঢ় বা শিথিল হয়ে পড়ে। তখন তা আর নির্ধারিত কাজ করতে পারে না। শৈশবে এটির সূত্রপাত হলেও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্রতা বাড়ে। শিশুর স্নায়ুর এ ভারসাম্যহীনতাকেই বলা হয় সেরিব্রাল পালসি, যার আক্ষরিক অর্থ মস্তিষ্কে আঘাতজনিত পক্ষাঘাত।
সেরিব্রাল পালসিকে সরাসরি কোনো রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। শিশুদের মস্তিষ্ক গঠনের সময় স্নায়ুকোষ কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্তরা নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো করতে অক্ষম হয়। অন্যের সহযোগিতা ছাড়া বসতে বা দাঁড়াতেও পারে না তারা। শিশুরা যেসব কারণে প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে তার অন্যতম সেরিব্রাল পালসি। তবে এর ধরন কেমন হবে বা কোন সমস্যা দেখা দেবে তা নির্ভর করে শরীর ও মস্তিষ্কের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার ওপর। মূলত মস্তিষ্কের বিকাশলাভের সময়টাতেই এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। সঠিক সময়ে ধরা না পড়া, সচেতনতার অভাবসহ নানা কারণে সেরিব্রাল পালসি শিশুর জীবনে বড় সংকট সৃষ্টি করে। তবে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে এ সমস্যার অনেকটুকুই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের আট বছরের নাজনীন আক্তার ও রাজধানীর ১৮ বছর বয়সী সাদিকুল ইসলামের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। জন্মের তিন বছর পর সেরিব্রাল পালসির লক্ষণ স্পষ্ট হয় নাজনীনের। তার সমস্যাটি ছিল কথা বলতে না পারা। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন চিকিৎসার পর বাংলাদেশে একটি বেসরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে বিশেষ পরিচর্যা বা পুনর্বাসনের আওতায় নেয়া হয় তাকে। নিয়মিত চিকিৎসা ও সেবার পর নাজনীন এখন অনেকটাই সুস্থ। একইভাবে হাঁটার সমস্যার ক্ষেত্রে অনেকটুকু অগ্রগতি হয়েছে সাদিকুলের। তার সেরিব্রাল পালসি শনাক্ত হতে কিছুটা সময় লাগলেও চার বছর ধরে নিয়মিত বিশেষ পরিচর্যার আওতায় রয়েছে এ কিশোর। চিকিৎসকরা বলছেন, শুরুতেই তাকে সেবার আওতায় আনতে পারলে সুস্থতার বিষয়ে আরো অগ্রগতি হতো।
তবে এ দুজনের মতো দেশে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত সবাই বিশেষ পরিচর্যা পায় না। গবেষণা বলছে, এ ধরনের সমস্যাযুক্ত শিশু-কিশোরদের ৫০ শতাংশই কোনো ধরনের পরিচর্যা বা পুনর্বাসনের আওতায় আসে না। ফলে শৈশবের এ সমস্যা তাদের আজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পাবলিক লাইব্রেরি অব সায়েন্সের জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত রিহ্যাবিলিটেশন স্ট্যাটাস অব চিলড্রেন উইথ সেরিব্রাল পালসি ইন বাংলাদেশ: ফাইন্ডিংস ফ্রম দ্য বাংলাদেশ সেরিব্রাল পালসি রেজিস্টার শীর্ষক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে সেরিব্রাল পালসি-সংক্রান্ত তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা নেই। ঠিক কত মানুষ এ মুহূর্তে এ সমস্যায় আক্রান্ত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই। ২০১৫ সালে চাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশনের (সিএসএফ গ্লোবাল) উদ্যোগে বাংলাদেশে সেরিব্রাল পালসির বিষয়টি নিবন্ধন শুরু হয়। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় দেশব্যাপী এ কাজ চলমান। তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে প্রায় তিন হাজার শিশু-কিশোরের তথ্য বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওই গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে। শূন্য থেকে ১৮ বছরের মধ্যে অবস্থান করা শিশু-কিশোরদের তথ্যই এখানে সন্নিবেশ করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ রিহ্যাবিলিটেশন বা বিশেষ পরিচর্যার সেবা পায় না। পরিচর্যার আওতায় যারা আসে তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ফিজিওথেরাপি বা শারীরিক চিকিৎসা পায়। ১১ শতাংশের ক্ষেত্রে পরামর্শমূলক সেবা ও ৯ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপকরণের সহায়তা মেলে। মূলত বেসরকারি সংস্থার কেন্দ্রগুলো থেকেই এসব পরিচর্যা পাওয়া যায়। সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ৪৫ শতাংশ বেসরকারি সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। হাসপাতালে সেবা পায় ৩১ শতাংশ ও ১১ শতাংশ বাড়িতেই সেবা পায়। আর বেসরকারি ক্লিনিকে এমন সেবার জন্য যায় ১০ শতাংশ ভুক্তভোগী।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন কারণে সেরিব্রাল পালসি সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত মাতৃগর্ভে, জন্মের সময়, জন্মের এক মাসের মধ্যে বা শিশুর জীবনের প্রথম বছরগুলোয় এ সমস্যার সূত্রপাত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যখন মস্তিষ্ক বিকাশ লাভ করে সে সময় এ সমস্যায় আক্রান্ত হয় শিশু। বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা, খিঁচুনি, দেখা, শোনা বা কথা বলার সমস্যা ও মেরুদণ্ডের পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো শিশুর জন্মের প্রাথমিক পর্যায়েই শুরু হয়। সিডিসি বলছে, ৮৫-৯০ শতাংশের ক্ষেত্রে এ সমস্যা জন্মগত।
সংস্থাটি বলছে, গর্ভবতী অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন করলে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় হাম, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ভাইরাস জ্বরের মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি হলে সন্তানের সেরিব্রাল পালসি হতে পারে। আবার অপরিণত শিশু ভূমিষ্ঠ হলে এবং জন্মের পর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হলে সেরিব্রাল পালসির ঝুঁকি থাকে। জন্মের পর মস্তিষ্কের সংক্রমণজনিত রোগ, কোনো ধরনের দুর্ঘটনার ফলে আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলেও এমন ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এমনকি বাবা-মা রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয় হলেও শিশুর স্নায়বিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁঁকি রয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, শৈশবকালীন শারীরিক এ অক্ষমতা আজীবন সুস্থতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্যই বিষয়টি উদ্বেগজনক। সারা বিশ্বে এমন শিশু-কিশোরদের ৮০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দা। বাংলাদেশে প্রতি হাজার শিশুর বিপরীতে ৩ দশমিক ৪ জন সেরিব্রাল পালসিতে ভুগছে। সে হিসেবে দেশের প্রায় আড়াই লাখ শিশু এ সমস্যায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। সাধারণত সচেতনতার অভাব, আর্থিক সংগতি না থাকা, শিক্ষার অভাব, কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে এ বিপুলসংখ্যক মানুষ পুনর্বাসন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গবেষক ইসরাত জাহান ও মানিক চন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ধরে সেরিব্রাল পালসি সমস্যার পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করছেন। তারা জানান, দেশে এমন রেজিস্টার আগে হয়নি। এবারই প্রথম।
মেডিকেল ক্যাম্প করে রেজিস্টার করার প্রথম পাঁচ বছরে প্রায় তিন হাজার শিশুর তথ্য গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে ইসরাত জাহান বলেন, আমাদের ক্যাম্পে যারা এ সমস্যা নিয়ে এসেছে আমরা তাদের শারীরিক অবস্থার পুরনো তথ্য পর্যালোচনা করেছি। তারা কখন বুঝতে পারল, আমাদের কাছে আসার আগে তারা কোথায় সেবা নিয়েছে, কীভাবে এ সমস্যা নির্ণয় করা করেছে তা জানার চেষ্টা করেছি। দেশে সরকারিভাবে এর চিকিৎসা খুবই কম। উপজেলা পর্যায়ে এর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা থেরাপিস্ট নেই। সেরিব্রাল পালসির ক্ষেত্রে যেসব পরিচর্যা জরুরি তা যথাযথভাবে দিতে পারলে এ সমস্যা অনেকাংশেই উত্তরণ করা যায়।
যেকোনো ধরনের সেরিব্রাল পালসির ক্ষেত্রে একই চিকিৎসা দেয়া হয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন ধরনের সেরিব্রাল পালসি হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে যে একই চিকিৎসা দেয়া হয় তা হলো থেরাপি ও কাউন্সেলিং। সাধারণত যাদের এ সমস্যা মাঝারি তারা যথাযথ পরিচর্যা বা চিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে। কিন্তু মারাত্মক আকার ধারণ করলে তাতে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসকের মতে, উন্নত দেশে জন্মগতভাবে শিশুর এ সমস্যা হলেও উন্নয়নশীল দেশে এটি গর্ভকালীন সমস্যা ও আঘাতজনিত কারণে হয়। সরকারিভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এমন শিশুদের জন্য বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে সহজেই তা নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে কয়েক মিনিট চিকিৎসা নিলে এ ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ন্ত্রণ বা নিরাময় হয় না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যা।
তবে সরকারিভাবে সেরিব্রাল পালসির চিকিৎসা ও পরিচর্যার বিষয়টি এখন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আলাদা করে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্নার করছি। এরই মধ্যে শতাধিক উপজেলায় কাজ শেষ হয়েছে। এতে চিকিৎসা ও পরিচর্যার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালে তো রয়েছেই, আমরা জেলা হাসপাতালেও এর জন্য ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্বও দেয়া হবে।