ময়মনসিংহ বিভাগের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষিজীবী। মাত্র ৪১ শতাংশ সাক্ষরতার হারসম্পন্ন বিভাগটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষই অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এখানকার কৃষকদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চার অভ্যাসও তেমন একটা দেখা যায় না। যদিও মানসিক ও কায়িক শ্রমের চাপ অনেক বেশি। বাসিন্দাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন নিয়ে সচেতনতাও তুলনামূলক কম। এমন আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও জীবনযাত্রা বিভাগটিতে অসংক্রামক বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়াচ্ছে, যা একই সঙ্গে বাড়াচ্ছে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও। দেশী-বিদেশী গবেষকদের সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে স্ট্রোকের রোগী সবচেয়ে বেশি এখন ময়মনসিংহ বিভাগে।
স্ট্রোকের সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার, অতিরিক্ত মানসিক ও কায়িক শ্রমের চাপ, খাদ্যাভ্যাসসহ জীবনযাপনের সামঞ্জস্য ব্যাহত হওয়ার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা। জীবনযাপনের এসব সংকট দেশের বাসিন্দাদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ, ডিসলিপিডেমিয়া, ডায়াবেটিস ও হূদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়াচ্ছে। এসব রোগে আক্রান্তদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।
জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তিনজন এবং যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক সম্প্রতি বাংলাদেশীদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাব নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালান। তাদের এ গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে স্ট্রোকের রোগী প্রতি হাজারে ১১ জন। এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগে। বিভাগটিতে হাজারে প্রায় ১৫ জন স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে খুলনা ও বরিশাল। এ দুই বিভাগে প্রতি হাজারে স্ট্রোকের রোগী পাওয়া যায় যথাক্রমে ১৪ ও ১৩ জন। ঢাকা ও সিলেটে এ হার প্রতি হাজারে ১২ জন। চট্টগ্রাম ও রংপুরে প্রতি হাজারে স্ট্রোকের রোগী যথাক্রমে ১১ ও নয়জন। সবচেয়ে কম রয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এখানে প্রতি হাজারে স্ট্রোকের রোগী আটজন। ‘প্রিভিলেন্স অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস অব স্ট্রোক ইন বাংলাদেশ: আ নেশনওয়াইড পপুলেশন বেজড সার্ভে’ শীর্ষক ওই গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল এলসেভিয়ারে প্রকাশিত হয়েছে।
ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোয় লোকসংখ্যা সোয়া কোটির বেশি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন নির্দেশকে পিছিয়ে রয়েছে বিভাগটি। তবে বিভাগটিতে সরকারিভাবে টারশিয়ারি পর্যায়ের বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে মাত্র একটি। বিভাগটির একমাত্র টারশিয়ারি ও একটি মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গিয়েছে, এখানে স্ট্রোকের জটিলতা নিয়ে যারাই আসছে, তাদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হূদরোগে ভুগছে। স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে প্রধানত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। আর আশঙ্কাজনক হলে পাঠানো হচ্ছে রাজধানীতে। ময়মনসিংহ বিভাগে জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় রোগের বোঝাও বেশি বলে মন্তব্য করেছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. শাহ আলম।
স্নায়ুরোগ নিয়ে আসাদের মধ্যে স্ট্রোকের জন্য প্রভাবক রোগগুলো তীব্রভাবে পাওয়া যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী স্ট্রোকের। স্ট্রোকের রোগীর মতো অন্য কোনো রোগী এত ভর্তি হচ্ছে না। একইভাবে বহির্বিভাগে যেসব রোগী আসছে তাদের মধ্যে মাথাব্যথার রোগীও প্রচুর। আমরা প্রতি সপ্তাহে হাসপাতালের বহির্বিভাগের স্ট্রোক ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবার পরিসর বাড়াই।
দেশে গত তিন দশকে মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে সংক্রামক রোগকে প্রতিস্থাপন করেছে অসংক্রামক ব্যাধি। বর্তমানে দেশে অর্ধেকের বেশি মৃত্যু হচ্ছে অসংক্রামক রোগের কারণে, যার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো স্ট্রোক। গত কয়েক দশকে পরিচালিত হাসপাতালভিত্তিক গবেষণায় ইসকেমিক ও হেমোরেজিক স্ট্রোকের প্রধান কারণ হিসেবে উচ্চরক্তচাপকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের নারী ও পুরুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হারে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। স্ট্রোকের জন্য প্রধানত দায়ী উচ্চরক্তচাপ। আর ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দাদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধানতম কারণ। আর উচ্চরক্তচাপ বৃদ্ধির জন্য সহায়ক বিষয়গুলো এ বিভাগের মানুষের মধ্যে দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত কায়িক পরিশ্রম, তামাক সেবন ও বেশি করে কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করতে দেখা যায় এ বিভাগের বাসিন্দাদের। একই সঙ্গে রোগ নিরীক্ষণের জন্য নিয়মিত পরীক্ষা বা চেকআপের বিষয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। যেখানে চল্লিশোর্ধ্ব মানুষের বছরে অন্তত দুবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। বয়স্করা উচ্চরক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিতে বেশি থাকছে।
দেশের পুরুষদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাব নারীদের তুলনায় বেশি বলে যৌথ গবেষণাটিতে উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, প্রতি হাজারে ১৪ জন পুরুষ স্ট্রোক রোগী রয়েছে। আর নারী রয়েছে নয়জন। যদিও গ্রামীণ এলাকায় স্ট্রোকের প্রকোপ ছিল প্রতি হাজারে ১১ দশমিক ৮ আর শহরাঞ্চলে ১১ দশমিক ৩ জন। এছাড়া বয়সভিত্তিক হিসাবে ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। প্রতি হাজারে ৩০ জনের বেশি স্ট্রোকের রোগী রয়েছে এ বয়সসীমায়। আর ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে প্রতি হাজারে নয়জন স্টোকের রোগী রয়েছে। ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের প্রতি হাজারে ১৫ জন ও ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে হাজারে ২৫ জন স্ট্রোকের রোগী রয়েছে।
দেশের জনসংখ্যার মধ্যে স্ট্রোকের বর্তমান ব্যাপকতা ও ঝুঁকির কারণ দেখতে গবেষণাটি করা হয় বলে জানালেন গবেষণাটির সমন্বয়কারী এবং জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. এটিএম হাসিবুল হাসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের স্ট্রোক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইসকেমিক স্ট্রোক। এ স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি হেমোরেজিক স্ট্রোক। এতে রক্তনালি ছিঁড়ে যায়। আর জন্মগতভাবে মস্তিষ্কে ফোসকা হলে রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজ স্ট্রোক ঘটে। দেশের যে এলাকায় এক হাজার মানুষ রয়েছে সে এলাকায়ই ১১ জন স্ট্রোকের রোগী পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাপী পুরুষরা বেশি স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকে। ৫০ বছরের কম বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে কিছু হরমোনাল প্রতিরোধী ব্যবস্থা রয়েছে। সে কারণে ৫০ বছর বয়সের পর নারী ও পুরুষ স্ট্রোক রোগীর ব্যবধান তেমন পাওয়া যায় না। এর নিচে হরমোনের প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে নারীরা স্ট্রোকের কম ঝুঁকিতে থাকে।
স্ট্রোকের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) ও যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে, মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহের বিঘ্নতার জন্য কোষের মৃত্যু ঘটে। তবে সব স্ট্রোকেই মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কের অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় অথবা মস্তিষ্কের রক্তনালি ফেটে যায়। স্ট্রোক দীর্ঘস্থায়ী মস্তিষ্কের ক্ষতি, দীর্ঘমেয়াদি অক্ষমতা এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। স্ট্রোক গুরুতর জীবন হুমকিমূলক একটি অবস্থা। এর জন্য জরুরি চিকিৎসা অপরিহার্য। স্ট্রোকের জন্য চিকিৎসা গ্রহণ যত দ্রুত হবে ক্ষতির আশঙ্কা তত কমে যাবে।
গবেষণা বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে ১ কোটি ৩ লাখ মানুষ স্ট্রোক করে। মারা যায় প্রায় ৬৫ লাখ। যারা স্ট্রোক করার পরও বেঁচে যায় তাদের বড় একটি অংশ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে বেঁচে থাকে। গত তিন দশকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় বছরে প্রতি লাখ জনসংখ্যার মধ্যে স্ট্রোকের রোগী ৫৬ থেকে ১১৭ জনে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, স্ট্রোকের ঝুঁকি আগের চেয়ে ক্রমেই বাড়ছে। এটা একসময় মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাবে। আমাদের দেশে অসুস্থ না হলে স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার অভ্যাস নেই। আমরা সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলো নিয়মিত করি না। ঝুঁকি কমাতে নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। ভেতরে ভেতরে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ বাড়ছে। এটা একসময় ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। ৪০ শতাংশ মানুষ জানেই না তাদের ডায়াবেটিস আছে। অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে এমনই। একইভাবে রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে জোর দিতে হবে। অসুস্থ হলে চিকিৎসা আর অসুস্থতার আগে প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এর জন্য আমাদের জীবনাচারে ইতিবাচক স্বভাব তৈরি করতে হবে।