স্থানীয়দের ভরসা ওষুধের দোকান: এক দশকেও হাসপাতাল পায়নি রাঙ্গাবালী উপজেলা

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা। সরকারি হিসাবে এ উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১ লাখ ৪ হাজার ১২৮। নদী ও সমুদ্রবেষ্টিত এ উপজেলার সঙ্গে অন্যান্য উপজেলা ও জেলা সদরের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বাদে নেই সরকারি কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। ফলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থানীয়দের একমাত্র ভরসা ওষুধের দোকান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ডিগ্রিবিহীন গ্রাম্য চিকিৎসক। উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ১০ বছর পেরোলেও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভীষণভাবে পিছিয়ে রয়েছে রাঙ্গাবালীর বাসিন্দারা।

রাঙ্গাবালী উপজেলায় প্রায় ১৭ হাজার পরিবারের বাস। এসব পরিবারের লক্ষাধিক মানুষের জন্য সরকারি পর্যায়ে কোনো হাসপাতাল নেই। ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও প্রতিটি ইউনিয়নে নেই ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা না থাকায় স্থানীয়রা নির্ভর করেন অনুমোদনবিহীন ওষুধের দোকানের পল্লী চিকিৎসকের ওপর। উপজেলায় সরকারি হাসপাতাল না থাকায় চিকিৎসকেরও নিয়োগ নেই। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে রয়েছে সেবা দেয়ার সীমাবদ্ধতা। গলাচিপা উপজেলার চিকিৎসকরা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে রাঙ্গাবালীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছেন। তবে অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে তারাও সব সময় সব সেবা দিতে পারেন না।

জেলা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জানা গিয়েছে, রাঙ্গাবালীতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি। উপজেলার বয়স ১০ বছর হলেও এর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো ধরনের পদ এখনো সৃষ্টি হয়নি। গলাচিপায় নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাই রাঙ্গাবালীর নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিসহ (ইপিআই) অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদন করেন। রাঙ্গাবালীর জন্য অর্গানোগ্রাম সৃষ্টি না করায় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাগজপত্রে এ স্থানটি গলাচিপা হিসেবে চিহ্নিত। অর্থাৎ আগে রাঙ্গাবালী যেমন গলাচিপার অংশ ছিল, কাগজে-কলমে তেমনই রয়েছে। তবে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৫০ শয্যার উপজেলা হাসপাতাল স্থাপন করা হবে। মন্ত্রণালয় থেকে এজন্য কার্যাদেশও দেয়া হয়েছে।

রাঙ্গাবালী উপজেলা চেয়ারম্যান ডা. জহির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, এ উপজেলার মানুষের প্রধানতম চাহিদা একটি পরিপূর্ণ সরকারি হাসপাতাল। জরুরি সময়ে স্থানীয়রা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পান না। কেউ হঠাৎ করে হূদরোগে আক্রান্ত হলে, স্ট্রোক করলে, সাপের কামড়ে আহত হলে তাত্ক্ষণাৎ সেবা নেয়ার জায়গা নেই। এমনকি পাশের উপজেলা গলাচিপায়ও প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যায় না। তখন যেতে হয় ৫০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলায়। সেখানেও নৌপথ ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। সদর উপজেলায় নেয়ার পথে প্রচুর রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আমরা চাই উপজেলায় বড় অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা হোক। যে হাসপাতাল নির্মাণের কথা চলছে, সেটি সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন হোক।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. এসএম কবির হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, চিকিৎসক, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও লোকবলের অভাবে জেলা-উপজেলাগুলোয় অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে না। উপজেলায় অবেদনবিদ নেই, ফলে অস্ত্রোপচার করা যায় না। স্ত্রীরোগের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথাগত চিকিৎসা পান। এ উপজেলার মানুষের জন্য ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় কার্যাদেশ দিয়ে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করবে।

শিগগিরই হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. সাইদুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়টি অনেকখানি এগিয়েছে। একই সঙ্গে পাশের উপজেলাগুলোয় চিকিৎসক ও চিকিৎসার স্বল্পতার বিষয়টিও আমলে নেয়া হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবাকে উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত করা প্রয়োজন। উপজেলায় সরকারি হাসপাতাল না থাকার কারণে স্থানীয়রা স্বাস্থ্যসেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, পাশাপাশি জাতীয় পরিসংখ্যানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যও পাওয়া যায় না। এসব অঞ্চলে কোন কোন রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে এবং তাতে কী প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেয়া যায় তার ধারণা জাতীয়ভাবে পরিষ্কার হয় না। একই ছাদের নিচে রোগ প্রতিরোধী ও চিকিৎসার সুবিধা না দেয়ার মধ্য দিয়ে ওই জনগোষ্ঠীকে মূলত সংবিধানে বর্ণিত স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়।

স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সদর উপজেলা বাদে ৪৯৪টি উপজেলার মধ্যে নয়টিতে নেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এগুলোর মধ্যে আটটিই গত ১০ বছরের মধ্যে গঠিত হওয়া উপজেলা। এগুলো হলো পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, খাগড়াছড়ির গুইমারা, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, কুমিল্লার লালমাই, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ, মাদারীপুরের ডাসার, কক্সবাজারের ঈদগাঁও ও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর। আর সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ২০১৪ সালে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় সেখানে কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেই। তবে ডাসার, কর্ণফুলী ও রাঙ্গাবালীতে ৫০ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবন নির্মাণের কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।

অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশির আহমেদ বলেন, সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা হাসপাতাল নির্মাণে নিয়মমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আমরা শুধু নির্দেশের বাস্তবায়ন করি।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার পটুয়াখালী প্রতিনিধি বাদল হোসেন)

Source: Bonik Barta

Share the Post: