স্নাতকে অকৃতকার্যের হার সবচেয়ে বেশি মেডিকেলে

দেশের উচ্চশিক্ষায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে থাকা বিষয়গুলোর অন্যতম চিকিৎসাবিদ্যা। মেডিকেল কলেজে একটি আসন নিশ্চিত করতে রীতিমতো ভর্তিযুদ্ধে নামতে হয় শিক্ষার্থীদের। প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় বাছাইকৃত এসব শিক্ষার্থীই হিমশিম খাচ্ছেন এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর স্নাতক পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি অকৃতকার্য হন মেডিকেলের এমবিবিএস পরীক্ষার্থীরা।

চিকিৎসা শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মতে, পদ্ধতিগতভাবে মেডিকেল শিক্ষা অন্যান্য শিক্ষার চেয়ে বেশ আলাদা। স্নাতক পর্যায়ের অন্যান্য ডিগ্রির তুলনায় এমবিবিএসের পাঠ্যক্রমের ব্যাপ্তিও অনেক বেশি। জীবনরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এ ডিগ্রির মূল্যায়ন পদ্ধতিও বেশ পুঙ্খানুপুঙ্খ। পাসের ন্যূনতম মানদণ্ড অনেক ওপরে। এছাড়া শিক্ষক ও অবকাঠামো সংকটে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে। সর্বোপরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের মতো পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফল প্রকাশের পর পাস-ফেলের হার নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। তবে বিকেন্দ্রীয় পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার কারণে স্নাতক বা এর পরবর্তী ধাপের পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রতি বছর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। এ প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিগ্রিভিত্তিক পরীক্ষার্থী ও উত্তীর্ণের তথ্য প্রকাশ করা হয়।

ইউজিসির গত কয়েক বছরের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি শিক্ষাবর্ষেই উত্তীর্ণের হারে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকছেন মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজগুলো থেকে ১ হাজার ৯৬৫ জন পরীক্ষার্থী এমবিবিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হন ১ হাজার ৩৭৯ জন। অর্থাৎ ওই শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭০ শতাংশ। যদিও একই শিক্ষাবর্ষে স্নাতক সম্মান পর্যায়ের ডিগ্রিগুলোয় গড় পাসের হার ছিল ৯২ শতাংশ। আর স্নাতক কারিগরি ডিগ্রিগুলোয় গড় পাসের হার ছিল ৮০ শতাংশ।

এর আগের শিক্ষাবর্ষেও ৬ হাজার ৪৭৫ জন এমবিবিএস পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেন ৩ হাজার ৮৩২ জন। ওই শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পাসের হার ছিল ৫৯ শতাংশ। যেখানে স্নাতক সম্মানের ডিগ্রিগুলোয় পাসের হার ছিল ৭৫ শতাংশ। কারিগরি স্নাতক পর্যায়ের ডিগ্রিগুলোয় এ হার ছিল ৭৬ শতাংশ।

২০১৬ থেকে ২০১৮—প্রতি শিক্ষাবর্ষেই এমবিবিএস পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৬৬ শতাংশ করে। যদিও একই শিক্ষাবর্ষগুলোয় স্নাতক সম্মান ও স্নাতক কারিগরি পর্যায়ের ডিগ্রিগুলোয় গড় পাসের হার ছিল ৮০ শতাংশের ওপরে।

চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি বা এমবিবিএস পেশাগত স্নাতক ডিগ্রি। সাধারণত কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোয় প্রায় একই শিক্ষাক্রমে এ ডিগ্রি দেয়া হয়। ব্যাচেলর অব মেডিসিন ও ব্যাচেলর অব সার্জারি দুটি ডিগ্রির সমন্বয়ে এমবিবিএস ডিগ্রি। পাঁচ বছর মেয়াদি এ ডিগ্রি মূল শিক্ষাক্রমের পর একটি নির্ধারিত মেয়াদে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে হয়, যার মেয়াদ এক বছর। শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করার পর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) চিকিৎসকের নিবন্ধন দিলেই কেবল তিনি চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত হন। দেশের প্রতিটি সরকারি বা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এমবিবিএস ডিগ্রি প্রদান করে। বিএমডিসির পাঠ্যক্রম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আয়োজন করে।

স্বাস্থ্যশিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিকেল শিক্ষার পাঠ্যক্রমের ব্যাপ্তি অন্যান্য স্নাতক ডিগ্রির চেয়ে বেশি। সাধারণত বিভিন্ন ডিগ্রির মধ্যে কোনো কোনো বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ, বেশি গুরুত্বপূর্ণ অথবা কম গুরুত্বপূর্ণ এমন ভাগ করা গেলেও এমবিবিএস কোর্সের ক্ষেত্রে আলাদা করা যায় না। প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের চুল থেকে শুরু করে কোনো বিষয়কেই কম গুরুত্ব দেয়া যায় না। মস্তিষ্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ফুসফুস, কিডনি, চোখও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ ডিগ্রিতে কিছুটা চাপ বেশি থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশনের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, রোগ শনাক্ত, প্রতিরোধ ও প্রারম্ভিক চিকিৎসার প্রতিটি বিষয়কে এমবিবিএস ডিগ্রিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়। স্নাতক পর্যায়ের অন্যান্য ডিগ্রির পাঠ্যক্রমের (সিলেবাস) চেয়ে এমবিবিএসের পাঠ্যক্রম বেশি সময় ধরে পড়তে হয়। পরীক্ষা পদ্ধতিও গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসাবিদ্যায় প্রশিক্ষণও বেশি। পদ্ধতিগতভাবেই পরীক্ষা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নেয়া হয়। শতকরা প্রায় অর্ধেক নম্বর পেয়ে পাস করতে হয়।

মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এমবিবিএস পাসের হার কম হওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষার এ বিশেষজ্ঞ বলেন, মেডিকেলে পাঠ্যক্রমের ব্যাপ্তি বেশি, সময় বেশি, পরীক্ষা পদ্ধতি জটিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকেরও স্বল্পতা রয়েছে। অনেক মেডিকেল কলেজে মৌলিক বিষয়গুলোর শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি যেমন—প্রশিক্ষণের পরীক্ষাগার ও আধুনিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতিরও ঘাটতি রয়েছে।

স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭। আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৭২টি। এর বাইরে ছয়টি মেডিকেল কলেজ সেনাবাহিনী পরিচালিত। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর প্রায় সাড়ে ১০ হাজার আসন রয়েছে। প্রতি শিক্ষাবর্ষে সরকারি কলেজগুলোয় ৪ হাজার ৩০০ এবং প্রায় সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থী বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।

মেডিকেল শিক্ষার ধরন অন্যান্য শিক্ষার মতো নয় উল্লেখ করে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. আরমান হোসেন বলেন, পদ্ধতিগতভাবে মেডিকেল শিক্ষা অন্যান্য শিক্ষার চেয়ে বেশ আলাদা, কিছুটা কঠিনও। তবে পাসের হার কম হলেও তা বেশি খারাপ নয়। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোয় প্রায় একই পাঠ্যক্রমে এমবিবিএস ডিগ্রি দেয়া হয়। শুধু পাঠ্যক্রমের কারণে অকৃতকার্যের হার প্রভাবিত হয় না। সময় উপযোগী করতে পাঠ্যক্রম ছয়-আট বছর পরপর পরিবর্তন করা হয়।

চিকিৎসাবিদ্যা জীবন রক্ষাকারী বিষয় মন্তব্য করে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এইচএম এনায়েত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, চিকিৎসাশিক্ষায় পড়াশোনার বিকল্প নেই। মেডিকেলের পড়াশোনা সাধারণত কিছুটা কঠিন। এক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারলে ডিগ্রি অর্জনে প্রভাব পড়ে। ধারাবাহিক বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় নির্দিষ্ট নম্বর পেয়ে কৃতকার্য হলেই ডিগ্রি পাওয়া যায়। সবগুলোতেই ভালো ফল করতে হয়। নির্দিষ্ট মানদণ্ডে নম্বর না পেলে তাকে পাস করানো হয় না। এখানে অন্যান্য ডিগ্রির মতো বিবেচনার সুযোগ নেই।

Source: Bonik Barta

Share the Post: