স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটে যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আবার যে পরিমাণ বরাদ্দ হয় তার পুরোটা ব্যয় করতে না পারায় প্রায় অর্থবছরই তা ফেরত যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত স্বাস্থ্যে বাজেটের আকার এবং তার যথাযথভাবে ব্যয়ে রয়েছে নানা জটিলতা। মানোন্নয়নে গুরুত্ব না দেয়ার পাশাপাশি এ খাতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনারও অভাব লক্ষণীয়। এসব কারণে প্রয়োজনীয় সেবাবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও বহুমুখী সীমাবদ্ধতায় পড়তে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুযায়ী দেশের মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকা উচিত। অথচ দেশে এ বরাদ্দ থাকে ৫ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরও (২০২৪-২৫) মোট বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ এ খাতে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি বা দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিলে আদতে সফলতা আসবে না। ভঙ্গুর স্বাস্থ্যকে সঠিকভাবে পরিচালনায় পুরো ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। এতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে মানোন্নয়ন ও যথাযথ ব্যবস্থাপনায়।
বাংলাদেশে সব সময় কিউরেটিভ বা চিকিৎসাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেট খুবই কম। অন্যদিকে চিকিৎসা গ্রহণে আউট অব পকেট পেমেন্ট (ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়) সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কিউরেটিভ। অর্থাৎ রোগ হলে চিকিৎসা নিতে হবে। কিন্তু রোগ হবে না এমন প্রিভেনটিভ বা প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নেই। সারা বিশ্বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এখন জনস্বাস্থ্য প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য হচ্ছে। আমরাও যদি সেদিকে না যাই তবে ব্যক্তি ব্যয় কমবে না। স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে দেশের মানুষ আরো দরিদ্র হচ্ছে।’
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডা. মোজাহেরুল হক আরো বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবার যে স্তরায়ন রয়েছে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। রেফারেল ব্যবস্থাপনা চালু না থাকায় কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানই সঠিকভাবে সেবা দিতে পারছে না। উপজেলাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে অতিপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে গুরুত্ব দিতে হবে জেলা ও বিশেষায়িত হাসপাতালকে। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল ও তাদের মানোন্নয়ন করতে হবে।’
চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে গত অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় ৩০ হাজার ১২৫ কোটি এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণে রাখা হয়েছে ১১ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এসব বরাদ্দে উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয়কেই বরাবরের মতো গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বছরে স্বাস্থ্য খাতের আকার ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে উল্লেখ করেছে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট।
কাঠামো অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাথমিক (উপজেলা পর্যন্ত), মাধ্যমিক (জেলা পর্যন্ত) ও টারশিয়ারি (বিশেষায়িত) পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসা, রোগ নির্ণয়, ওষুধ ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, জনস্বাস্থ্য, প্রমোশন-প্রতিরোধমূলক সেবা, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্য। আর স্বাস্থ্য শিক্ষায় রয়েছে গবেষণা, চিকিৎসা শিক্ষা, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
সব পর্যায় ও শাখাকে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা না করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে ভালো করা যাবে না বলে মনে করেন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার যে বাজেট পাস করেছিল, তার কাজই শুরু হয়নি। কেননা টাকাই তো নেই। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত পুরো ব্যবস্থাপনাকে সঠিকভাবে সাজানো। স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা শিক্ষা, ওষুধ, যন্ত্রপাতি এসব আলাদা করে ধরলে হবে না। বিক্ষিপ্তভাবে কাজ করলে তাতে আদতে কোনো উপকার হবে না। ডব্লিউএইচওর যে ব্লকগুলো রয়েছে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যেমন সচেতনতা ও নেতৃত্ব, চিকিৎসাসেবা, গবেষণা, দক্ষ জনবল, ইকুইপমেন্ট, ওষুধ, মেডিকেল টেকনোলজি—সবগুলোয় হাত দিতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সুশাসন ও জবাবদিহিতা। এসব না থাকলে কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা যাবে না।’
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয় তার বড় একটি অংশ প্রতি বছরই অব্যবহৃত থেকে যায়। ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪—এ পাঁচ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে অব্যয়িত অর্থের হার বেড়েই চলেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের জন্য বরাদ্দের ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ ফিরে গেছে। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে যথাক্রমে বরাদ্দের ২ দশমিক ১০ ও ২ দশমিক ১৬ শতাংশ অর্থ অব্যয়িত থাকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফেরত গেছে ২১ দশমিক ৭২ শতাংশ অব্যয়িত অর্থ।
স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের বরাদ্দ বছর শেষে ফিরে যাওয়াকে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যে এমনিতেই বরাদ্দ কম। একই সঙ্গে সেই বরাদ্দের বড় একটি অংশ ফিরে যায়, এটা অদক্ষতা। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পুরোটাই পচে গেছে। শুধু পচে যায়নি, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এটার সহজ সমাধান নেই। এ খাত অনেকগুলো খাতের সমষ্টি। সেবার মধ্যে—চিকিৎসা, ওষুধ, রোগ নির্ণয়, ইকুইপমেন্টসহ বহু কিছু রয়েছে। একই সঙ্গে চিকিৎসা শিক্ষায়ও রয়েছে বেশকিছু বিষয়। এর বাইরে পুষ্টি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য রয়েছে। এ বিশাল অংশগুলোর প্রতিটিই অব্যবস্থাপনায় ভুগছে। একটি বা দুটি বিষয় নিয়ে কাজ করলে তা সঠিক পথে আনা যাবে না।’
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদের মতে, ‘এ খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবাকে আবার বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। শহরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। তবে শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বলতে কোনো কার্যক্রম নেই। চিকিৎসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমেও পরিবর্তন আনা জরুরি। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রশাসন, প্রিভেন্টিভ বা প্রভিশনাল—এ ভাগগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু দেশে একটা পরিবর্তন এসেছে তাই এখনই সময় এসব বিষয়কে ঢেলে সাজানোর।’