স্বাস্থ্য খাতে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার অগ্রাধিকার প্রকল্প: এক বছরে পরিকল্পনা ও বরাদ্দের মাত্র ৫ শতাংশ বাস্তবায়ন

গত বছরের শুরুতে দেশে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও মান উন্নয়নের জন্য দুটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এর মধ্যে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ এবং সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ নামের বড় একটি প্রকল্প নেয়া হয়। তিন বছরের জন্য শুরু হওয়া প্রকল্পটিতে প্রথম বছরে পরিকল্পনা ও বরাদ্দের মাত্র ৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্টিয়ারিং কমিটি।

সভার কার্যপত্র সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ওই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এআইআইবি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১০০ মিলিয়ন ডলার যৌথভাবে ঋণ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অনুরোধে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের আওতায় টিকা কেনার জন্য অতিরিক্ত ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ প্রতিশ্রুতি অর্থায়নের কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে সংশোধিত ডিপিপি গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। সংশোধিত ডিপিপিতে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ১৭২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবির ঋণ ৬ হাজার ৬১৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটির অনুমোদিত মেয়াদকাল ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছর এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ১৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অর্থাৎ এক অর্থবছরে এ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৫ শতাংশেরও কম। একই সময়ে এ প্রকল্পের আওতায় টিকা কেনার জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তবে এ প্রকল্পে অগ্রগতিও অনেক কম।

জানা গেছে, শুরুতে অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পটি গতি হারায়। পরে দুজন প্রকল্প পরিচালককে সরিয়েও দেয়া হয়। এরপর কাজ শুরু করা হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চিঠি চালাচালিতে আবারো ধীরগতি নেমে আসে। এতে গত অর্থবছরে প্রকল্পের কাজের পরিকল্পনা অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি।

প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভাপতি লোকমান হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে সম্প্রতি কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রকল্পের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদ দেয়া হয় প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের।

স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্প পরিচালকের পক্ষে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রকল্পটিতে বরাদ্দকৃত ২ হাজার ৭৫১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। যেখানে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে গত অর্থবছর ৪৩টি জেলা হাসপাতাল, ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়। যার মধ্যে ১০টি জেলা হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের নকশা চূড়ান্ত হয়েছে। অবশিষ্ট আইসিইউগুলোর নকশা চূড়ান্তের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর মেরামত বা সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এতে চিকিৎসা যন্ত্রাংশ ক্রয়ের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে গত অর্থবছরে যেসব প্যাকেজে এসব যন্ত্রাংশ কেনার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল, তার আর্থিক মূল্য এখনো পরিশোধ করা হয়নি। যে কারণে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে।

র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার কিট, রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পোলিমারস চেইন রিঅ্যাকশন (আরটিপিসিআর) কিট, সার্জিক্যাল মাস্ক এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) কেনা বাবদ চলতি অর্থবছরে ৫১০ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে অ্যান্টিজেন কিট কেনার প্যাকেজটির মূল্যায়ন শেষ হয়েছে। তবে আরটিপিসিআর কিট, সার্জিক্যাল মাস্ক এবং পিপিই কেনার দরপত্র প্রক্রিয়াকরণই শুরু হয়নি। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় টিকা কেনার জন্য ১ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও অর্থ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে জরুরি ভিত্তিতে কভিড-১৯ টিকা কেনার উদ্যোগ নিতে স্টিয়ারিংয়ের সভায় একমত পোষণ করা হয়।

সভায় বলা হয়, এ প্রকল্পে ২৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরটিপিসিআর ল্যাব স্থাপনের সংস্থান রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি পিসিআর ল্যাব স্থাপনে সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আটটির কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য পিসিআর মেশিন ক্রয়ের দরপত্র মূল্যায়ন চলমান রয়েছে। তবে আইসিইউ ভেন্টিলেটর, ইসিজি মেশিন এবং কার্ডিয়াক মনিটর কেনার কার্যক্রম শুরু করা হয়নি। একই সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের টিকা পরীক্ষাগারকে শক্তিশালীকরণ বিষয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির কারিগরি শর্ত নির্দিষ্ট করা এবং এর দাপ্তরিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর জন্য দরপত্রের মূল্যায়নও চলমান রয়েছে।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সমন্বয়হীনতা নির্ধারিত সময়ে জরুরি কাজও বাস্তবায়ন হয় না বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সরকারি কাজের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। তার অবসান হয়নি। জরুরি কাজের ক্ষেত্রেও তা বিদ্যমান রয়েছে। একই সঙ্গে তৃতীয় পক্ষের সুবিধা নেয়ার বিষয়টি বহাল থাকায় কাজে ধীরগতি দেখা যায়। প্রথম অর্থবছরের কাজ ৫ শতাংশের কম হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ শেষ নাগাদ ৫০ শতাংশও না হওয়ার আশঙ্কার কথা জানান এ বিশেষজ্ঞ।

তবে প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রকল্পের শুরুতে সময়ক্ষেপণ হয়েছে বেশি। শুরুতে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও আরটিপিসিআর ল্যাব বসানোর বিষয়ে সার্ভে করা হয়েছে। এতে অনেক সময় স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ধীরগতিতে সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে প্রায় সিংহভাগ কাজ গণপূর্ত অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করছে। আলাদা কর্তৃপক্ষ হওয়ায় এখানেও কিছুটা ধীরগতি হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার’ অপারেশনাল প্ল্যানের লাইন ডিরেক্টর ডা. মোহাম্মাদ আজিজুল রহমান সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, আমি এ প্রকল্পের তৃতীয় পরিচালক। এর আগে আরো দুজন পরিচালক ছিলেন। আমি প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছি এ বছরের শুরুতে। এর মধ্যে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি। প্রকল্পের বড় অংশের অর্থই টিকায় ব্যয় হবে। এতে ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এক্ষেত্রে খরচের কোনো সুযোগ নেই। কেননা টিকা কেনার বিষয়টি আমাদের ওপর নির্ভর করে না। আর বাকি কাজগুলো অবকাঠামোর। এ অবকাঠামো নির্মাণ চলছে। অবকাঠামোতে শুরুতে কিছুটা সময় লাগে। তবে এ কাজ দ্রুতই এগিয়ে যায়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: