স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি: অসচ্ছলদের জন্য পাইলট প্রকল্পে সুবিধা নিচ্ছে সচ্ছল পরিবার

বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারণের মান আগের চেয়ে বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে জীবনযাপনের খরচও। বিশেষ করে চিকিৎসা খাতে ব্যয় অনেক ক্ষেত্রেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আওতার বাইরে চলে গেছে। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, কেবল ব্যয় মেটানোর ক্ষমতা না থাকায় অনেক মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পান না। আবার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার নজিরও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি নামে স্বাস্থ্যবীমা চালু করছে। শুরুতে দরিদ্রদের জন্য চালু করা হলেও ধীরে ধীরে এর পরিসর বাড়িয়ে এক পর্যায়ে দেশের সব মানুষকে এ বীমার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

গত ছয় বছর ধরে দেশের তিনটি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এ কর্মসূচি চলছে। শুরুতে কথা ছিল পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বীমার আওতায় আনা হবে। কিন্তু দেখা গেছে, যারা এ বীমা সুবিধা পাচ্ছেন, তাদের ৪২ শতাংশেরই অবস্থান দারিদ্র্যসীমার ওপরে। এ স্বাস্থ্যবীমার কারণে সেবাগ্রহীতাদের চিকিৎসার বাড়তি খরচ কমে গেছে, তারা বিনামূল্যে ওষুধ পাচ্ছেন, চিকিৎসার প্রতিও আগ্রহ ফিরেছে। কিন্তু এর পরও বেশকিছু সমস্যার কথা উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক জরিপে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণসহ অন্য সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করা হচ্ছে।

সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এর আওতায় দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) নামে এ স্বাস্থ্যবীমা চালু করা হয়। প্রথম ধাপে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণের জন্য পরীক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এতে ২০১৬ সালের মার্চে টাঙ্গাইলের কালিহাতী এবং ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলায় এ কার্যক্রম শুরু হয়। এসব উপজেলায় প্রায় ৮২ হাজার দরিদ্র পরিবারকে একটি করে স্বাস্থ্য কার্ড দেয়া হয়। এ কার্ড প্রদর্শনের মাধ্যমে এসব পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে ভর্তি, ৭৮টি রোগের পরীক্ষা, ওষুধ ও বিনামূল্যে পূর্ণ চিকিৎসা পাচ্ছেন। পাশাপাশি পরিবারপ্রতি বছরে বীমার ১ হাজার টাকা প্রিমিয়ামও দিচ্ছে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি পরিবার বছরে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা পাবে।

পরীক্ষামূলক এ কর্মসূচিতে কোনো সমস্যা দেখা দিচ্ছে কিনা বা সমস্যার প্রকৃতি নির্ধারণে একটি পর্যালোচনা জরিপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। এ জরিপে তিন উপজেলার ৭০টি গ্রামের কার্ডধারী সাত হাজারের বেশি পরিবারের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার যে মানদণ্ড তার ওপরে অবস্থান করছে ৪২ শতাংশ কার্ডধারী পরিবার। এর মধ্যে কালিহাতীতে ৪৪ শতাংশ পরিবার, ঘাটাইলে ৪৯ শতাংশ ও মধুপুরে ৩৭ শতাংশ পরিবারের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার ওপরে। ফলে সঠিক নির্ণায়ক মেনে দরিদ্র পরিবারের তালিকা তৈরি করা হয়নি বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী মহল স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিতে দরিদ্র পরিবার বাছাইয়ে প্রভাব রেখেছে বলেও সেখানে উঠে আসে। এদিকে কার্ডধারী ৪৫ শতাংশ পরিবার এর ব্যবহার জানে না বলেও দেখা গেছে।

এ কর্মসূচি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য শুরুতেই স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা পাবেন কার্ডধারী পরিবারের সদস্যরা। সেখানে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকলে তাদের পরবর্তী চিকিৎসার জন্য জেলা হাসপাতালে পাঠানো হবে। এক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ, পরিবহনসহ যাবতীয় খরচ বীমা থেকে পাওয়া যাবে।

কালিহাতী উপজেলা এসএসকের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও কালিহাতী উপজেলার চেয়ারম্যান মো. আনছার আলী বণিক বার্তাকে জানান, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় হতদরিদ্র, দরিদ্র, শ্রমিক ও দিনমজুর শ্রেণীর মানুষ। মূলত যাদের নির্দিষ্ট কোনো মাসিক আয় নেই, তাদেরই দরিদ্র বলে চিহ্নিত করেছেন তারা। তবে এ তালিকা তৈরি একটি চলমান প্রক্রিয়া বলেও উল্লেখ করেন কমিটির সভাপতি। তিনি জানান, ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে তালিকা যাচাই-বাছাই করে তা স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পরে তালিকা চূড়ান্ত হয়। অবশ্য দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণের শর্তগুলো তাদের জানা নেই বলেও স্বীকার করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, যে পরিবার মাসে ৯ হাজার ৩০৫ টাকার কম আয় করে সে পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে। ছয় বছর আগে এ কর্মসূচির পরীক্ষামূলকভাবে শুরুর সময় দেখা গেছে, এসএসকে সুবিধাভোগী ৫৮ শতাংশ পরিবারের প্রাক্কলিত মাসিক আয় ৯ হাজার ২৮ টাকা।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদাৎ হোসেন মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, কোনো প্রকল্প চূড়ান্তভাবে শুরুর আগে সমস্যাগুলো তুলে আনার জন্যই মূলত ছোট পরিসরে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো হয়। সে হিসেবে তিন উপজেলায় পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে কার্যক্রম শুরুর পর দেখা গেল দরিদ্র পরিবার বাছাইয়ে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তাই এখন আমরা নতুন করে দরিদ্র পরিবার বাছাইয়ের নির্দেশিকা ধরে কাজ করছি। স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে কাজ চলছে। আমাদের একটি দল সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণও করছে। আমরা সব সমস্যা সমাধান করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।

তবে এ স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিকে পুরোপুরি সফল বলছেন না স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এর কিছুটা সুফল পাচ্ছেন সুবিধাভোগীরা। সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়াতে দরিদ্র পরিবার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। তাহলেই কেবল এর সর্বোচ্চ সফলতা সম্ভব।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আটঘাট বেঁধে নামতে হবে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জনবলের সংকটসহ চলমান প্রতিবন্ধকতাগুলো সমাধান করা না গেলে বড় পরিসরে কর্মসূচি ফলপ্রসূ হবে না। এর জন্য স্বতন্ত্র একটি জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন হলে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও এ কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে। পরীক্ষামূলক প্রকল্পের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে ধাপে ধাপে এ কার্যক্রম সারা দেশে সম্প্রসারিত হবে। বর্তমানে এ বীমার প্রিমিয়ামের অর্থসহ প্রকল্পের যাবতীয় ব্যয় স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি উন্নয়ন সেক্টরের উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে দেয়া হচ্ছে। তবে পরে সরকারি বরাদ্দ ও সচ্ছল পরিবারের কাছ থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহের মাধ্যমে কর্মসূচির অর্থ জোগানের পরিকল্পনাও রয়েছে। টাঙ্গাইলের বাকি উপজেলা ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কিছু এলাকাকেও শিগগিরই পাইলট প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। টাঙ্গাইল ও ঢাকার সব উপজেলায় এ পাইলট প্রকল্প চলবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত।

Source: Bonik Barta

Share the Post: