দেশের মানুষের চিকিৎসায় আর্থিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) চালু করেছে সরকার। বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলায় এ কর্মসূচি পুরোদমে চালু রয়েছে। এছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং আরো ছয় জেলায় এ সুবিধা চালুর কার্যক্রম চলমান। এরই মধ্যে সরকারি এ স্বাস্থ্যবীমা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী দরিদ্রদের একটি প্রাথমিক তালিকাও করা হয়েছে। তবে এ তালিকা ধরে রাজধানীতে নিবন্ধন করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। কেননা অধিকাংশেরই কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর যারা দরিদ্র তাদের বেশির ভাগই ভাসমান মানুষ। নিজ জেলায় তাদের কেউ নদীভাঙনে বসতবাড়ি কিংবা কৃষিজমি হারিয়েছে, কেউ বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে নিঃস্ব হয়েছে, কেউ অস্থায়ী কর্মের খোঁজে ঢাকায় এসেছে। তারা সবসময় এক স্থানে অবস্থান করে না। ফলে ছয় মাস বা বছরান্তে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে তারা স্থান ত্যাগ করে। অথবা জীবিকার জন্য রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যায়। ফলে শুরুতে প্রাথমিক তালিকায় তাদের নাম থাকলেও নিবন্ধন করতে গিয়ে বেশির ভাগকেই পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্যবীমার এ কর্মসূচি সাত বছর আগে টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। এরপর তা চালু করা হয় জেলার ১২টি উপজেলায়। এ কার্যক্রমের বর্ধিত অংশ আরো ছয়টি জেলা ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে শুরু হচ্ছে। এর জন্য দরিদ্র পরিবারের প্রাথমিক তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি নামে চালু করা হয়েছে স্বাস্থ্যবীমা। প্রাথমিকভাবে ২০১৬ সালের মার্চে টাঙ্গাইলের কালিহাতী এবং ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলায় কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে ওই তিন উপজেলায় দরিদ্র ৮২ হাজার পরিবারকে একটি করে স্বাস্থ্য কার্ড দেয়া হয়। এ কার্ডের আওতায় তখন পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি ও ৭৮টি রোগের পরীক্ষা, ওষুধ ও বিনামূল্যে পূর্ণ চিকিৎসা পেতেন। ব্যয় নির্বাহের জন্য বছরে পরিবারপ্রতি সরকার ১ হাজার টাকা প্রিমিয়ার হিসেবে দিয়েছে। তবে প্রতিটি পরিবার বছরে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা পাবে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করছে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বলছে, বর্তমানে ১১০টি রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কার্ডধারী পরিবারের সদস্যরা শুরুতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে তাদের এসএসকের বুথে পাঠানো হয়। সেখানে কার্ড যাচাই শেষে তাদের পাঠানো হয় হাসপাতালের বহির্বিভাগে। তাদের ১১০টি রোগের বেনিফিট প্যাকেজ বা সুবিধা দেয়া হয়। দেয়া হয় চিকিৎসকের পরামর্শ। প্রয়োজনবোধে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উপজেলা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকলে তাদের পাঠানো হয় জেলা হাসপাতালে। এক্ষেত্রে পরিবহন খরচও বহন করা হয় কর্মসূচির আওতায়।
রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে চলতি মাসে এ সেবা কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য-অর্থনীতি ইউনিট। এরই মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি কার্ড ছাপানো হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ লাখ ২০ হাজার ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। এখন সেসব পরিবারের নিবন্ধন করতে মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম চলমান। তালিকা প্রস্তুত ও নিবন্ধন কার্যক্রমের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে রাজধানীতে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল না থাকায় সুবিধাভোগীদের সেবা দেয়া হবে মাধ্যমিক (জেনারেল) ও বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) পর্যায়ের হাসপাতালে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কার্ডধারীরা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে সেবা পাবেন। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কার্ডধারীরা সেবা নেবেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
কর্মকর্তারা জানান, দরিদ্র পরিবারের তালিকা প্রস্তুত ও নিবন্ধন কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ কার্যক্রম চলতে থাকবে। রাজধানীতে এ কার্যক্রম বাড়ানো হবে। তবে যেসব দরিদ্র পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল এখন নিবন্ধনের জন্য গিয়ে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। তালিকা থেকে অন্তত ৫০ শতাংশ পরিবারকে নিবন্ধন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ঢাকা উত্তরের ২৫ হাজার তালিকাভুক্ত পরিবারকে নিবন্ধন করা হয়েছে। আর দক্ষিণে করা হয়েছে ৪৫ হাজার পরিবারকে।
ঢাকায় তালিকাভুক্ত অর্ধেক দরিদ্র পরিবারকে না পাওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য-অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘তালিকা প্রস্তুত করার এক বছর পর অর্ধেকের মতো পরিবারকে পাওয়া যাচ্ছে না, এটা অস্বাভাবিক। যারা তথ্য সংগ্রহ করেছেন তারা সঠিকভাবে কাজ করেছেন কিনা তা যাচাই করা উচিত। কেননা ২০-২৫ শতাংশ পরিবার মাইগ্রেশন (এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাওয়া) করলে তা স্বাভাবিক ছিল। আর ঢাকায় দরিদ্র পরিবারকে শনাক্ত করার পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ। আমাদের প্রস্তাব ছিল পেশার মাধ্যমে দরিদ্র পরিবার শনাক্ত করার বিষয়ে।’
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি চলমান। বর্তমানে জেলাটিতে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৩৭টি পরিবার এসএসকের সুবিধা পাচ্ছে। এ তালিকা আবার পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। এতে মোট পরিবারের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে আড়াই লাখের বেশি। এসএসকে কার্যক্রমে নতুন করে যুক্ত জেলার মধ্যে মানিকগঞ্জের ১ লাখ ২০ হাজার, লক্ষ্মীপুরে ১ লাখ ৬০ হাজার, বরিশালে ১ লাখ ৭০ হাজার, বরগুনায় ৮০ হাজার, লালমনিরহাটে ১ লাখ ২৮ হাজার ও কুড়িগ্রামে ৩ লাখ ৮০ হাজার দরিদ্র পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। এদের নিবন্ধন কার্যক্রম চলমান। চলতি মাসে মানিকগঞ্জ সদর, সাটুরিয়া ও ঘিওর; বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া; বরগুনার আমতলী ও বামনা; লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ও হাতিবান্ধা; কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলায় কার্ড বিতরণ কার্যক্রম শুরু হবে। লক্ষ্মীপুরের দুই উপজেলায় এরই মধ্যে কার্যক্রমটি চলছে।
পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে টাঙ্গাইলের বাইরে ছয়টি জেলায় এসএসকের কার্যক্রম বর্ধিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. এনামুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু গবেষণা করি এবং সরকারের নীতির বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করি। এ কার্যক্রম সারা দেশে যখন চালু করা হবে তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা বাস্তবায়ন করবে। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করার। রাজধানী ঢাকায় আমরা শুরু করব। এ কর্মসূচি আগে শহরাঞ্চলে পরিচালিত হয়নি। এখন কিছু কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নিবন্ধনের সময় তালিকাভুক্ত পরিবারগুলোকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মোবাইল নাম্বারও বন্ধ পাওয়া যায়। গ্রামাঞ্চলে হলে কোনো পরিবারকে পাওয়া না গেলেও প্রতিবেশীদের মাধ্যমে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। শহরে কর্মের জন্য তালিকাভুক্তরা নিজেদের স্থান পরিবর্তন করতে পারেন। সাধারণত ঢাকায় যারা দরিদ্র তাদের বেশির ভাগই ভাসমান মানুষ। এক স্থানে তারা অনেক দিন অবস্থান করে না। অথবা গ্রামে তাদের জীবিকা ছিল না বলে ঢাকা এসেছিল, পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে আবার ফিরে যেতে পারে।’
এদিকে কর্মসূচিতে কী কী সমস্যা দেখা দিচ্ছে তার মূল্যায়নের জন্য দুই বছর আগে একটি জরিপ করা হয়। পর্যালোচনা জরিপটি করে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সহায়তায় ওই জরিপে টাঙ্গাইলের তিন উপজেলার ৭০টি গ্রামের কার্ডধারী সাত হাজারের বেশি পরিবারের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন দেখা যায়, ৪২ শতাংশ কার্ডধারী পরিবারের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার ওপরে। সঠিক নির্ণয়ক মেনে দরিদ্র পরিবারের তালিকা তৈরি হয়নি উল্লেখ করে জরিপে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিতে দরিদ্র পরিবার বাছাইয়ে প্রভাব রেখেছে। একই সঙ্গে ৪৫ শতাংশ পরিবার জানে না এ কার্ডের সঠিক ব্যবহার।
টাঙ্গাইলে সুবিধাভোগীদের মধ্যে প্রকৃত পক্ষে দরিদ্র রয়েছে ৩০-৪০ শতাংশ উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘এভাবে দরিদ্র পরিবার খুঁজে এসএসকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যাবে না। দেশের সব পরিবারকে এ সুবিধার আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় একই হাসপাতালে কাউকে সুবিধা দেয়া হবে আর কাউকে দেয়া হবে না, তাতে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। আর গরিবদের জন্য কোনো কিছু করা হলে তাতে মানের বিষয় বিবেচনার বাইরে থাকে। সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে যখন একই ছাদের নিচে একই সেবা দেয়া হবে তখন মান নিশ্চিত করা হবে। দেশের সব পরিবারকে এসএসকে দিলে খরচ বাড়বে না। সরকারের বাজেটে বিদ্যমান বরাদ্দের মধ্যেই তা সম্ভব। কেননা প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ফেরত যায়।’