হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা: জরুরি সেবাবঞ্চিত ৮ জেলার কভিড রোগীরা

ঢাকা বিভাগের মাদারীপুরে করোনা সংক্রমণের হার ২৬ শতাংশ। উচ্চমাত্রার সংক্রমণে সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে জেলায় এখন পর্যন্ত নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের ব্যবস্থা নেই। এর বিকল্প হিসেবে সংকটাপন্ন কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের জরুরি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা (এইচএফএনসি) যুক্ত করা হয়নি। এতে সংকটাপন্ন রোগীদের নিয়ে স্বজনরা পার্শ্ববর্তী জেলা বা বিভাগে ভিড় করছেন। তবে অনেক সময় চরম সংকটাপন্ন রোগীদের অন্যত্র নেয়া সম্ভব হয় না।

শুধু মাদারীপুরই নয়, দেশে এমন আটটি জেলায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা যুক্ত করতে পারেনি সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। কোথাও কোথাও স্বল্পসংখ্যক ক্যানুলা পাঠানো হলেও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সংযোগ অথবা কারিগরি দক্ষতার অভাবে তা চালু করা হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইসিইউর বিকল্প হিসেবে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কাজ করে। এতে সংকটাপন্ন রোগীদের জরুরি সেবা অব্যাহত রাখা যায়। তারা বলছেন, করোনায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া রোগীদের জন্য হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যন্ত্রটি প্রতি মিনিটে একজন রোগীকে ৭০-৮০ লিটার পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। যেসব ক্ষেত্রে রোগীকে আইসিইউ সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না সংকটের কারণে, সেক্ষেত্রে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সংকটাপন্ন রোগীর জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের আটটি জেলার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এখনো হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সংযুক্ত করা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিভাগের মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুর; ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা; চট্টগ্রাম বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এসব জেলায় করোনার সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে মাদারীপুরে সংক্রমণের হার ২৬ শতাংশ, রাজবাড়ীতে ৩৫, কুড়িগ্রামে ৪১, গাইবান্ধায় ৩৩ এবং বাকি জেলাগুলোয় ২০ শতাংশের কাছাকাছি।

সম্প্রতি দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন জেলার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সংকট শুরু হয়। এসব জেলায় জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দেয়। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারেও হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা মজুদ নেই বলে জানা গেছে। আট জেলায় কোথাও কোথাও এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন স্থাপন শেষ হয়নি, আবার কোথাও শুরু হয়েছে মাত্র।

নেত্রকোনার সিভিল সার্জন ডা. মো. সেলিম মিঞা বণিক বার্তাকে জানান, জেলা সদর হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে ন্যাজাল ক্যানুলার সংযোগ দেয়া হবে। তবে জেলাটিতে চাহিদা অনুযায়ী একটিও ন্যাজাল ক্যানুলা আসেনি।

অন্যদিকে কোনো কোনো জেলায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন স্থাপনের কাজ শেষ হলেও মজুদ না থাকায় এইচএফএনসি সরবরাহ করতে পারেনি সরকার। এমনই একটি জেলা মুন্সীগঞ্জ। এ জেলায় অক্সিজেন থাকলেও যুক্ত হয়নি ক্যানুলা। জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা মাসখানেক আগে ১০টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার চাহিদা দিয়েছিলাম, পরে আরো পাঁচটি দিয়েছি। কিন্তু মজুদ না থাকায় এখন এগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পরে খুব দ্রুত সংস্থান করা হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আমাদের জানিয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য সহজ সমাধান হলো হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা। শ্বাসকষ্টের রোগীকে আইসিইউতে না নিয়েও এ যন্ত্রের সাহায্যে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচানো যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএফএনসির জন্য আলাদা কোনো অবকাঠামোর প্রয়োজন নেই। যেসব হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের সুযোগ রয়েছে, সেখানেই এর সংযোগ দেয়া যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালগুলোয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিভাইসটি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য।

এইচএফএনসির সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ানো কঠিন নয় বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সংক্রমণের গতিবিধিতে বোঝা যাচ্ছে, গত মার্চ-এপ্রিলের মতো দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়বে। সংক্রমণ তা ছাড়িয়েও যেতে পারে। বর্তমানে যে সংখ্যক হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে, তাতে চিকিৎসা অব্যাহত রাখা যাবে না।

মাত্র মাসখানেক সময়ের ব্যবধানে দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকালও দেশে প্রায় ছয় হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের পরিস্থিতি গত মার্চ-এপ্রিলের চেয়ে খারাপ হতে পারে। গত কয়েক মাসে হাসপাতালের আইসিইউ, এইচএফএনসি বৃদ্ধি পেলেও তা পর্যাপ্ত নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে করোনা রোগীদের জন্য এইচএফএনসির সংখ্যা ১ হাজার ৬১০টি। এর মধ্যে রাজধানীতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৪৮৬টি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩৫২টি। অন্যদিকে নয়টি জেলায় মাত্র একটি করে ক্যানুলা রয়েছে। যদিও দাম ও স্থাপন সহজ হওয়ায় সংখ্যা বাড়ানো জটিল নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

যেসব জেলায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সুবিধা এখনো যুক্ত হয়নি সেসব জেলাকে দ্রুত প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কিছু হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন বাকি রয়েছে। কিছু হাসপাতালে কাজ শেষ পর্যায়ে। এগুলো দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: