অতিসংক্রামক রোগ জলবসন্ত (চিকেন পক্স) মূলত গরমের শুরুতে দ্রুত সংক্রমিত হয়। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাদের মধ্যে সংক্রমণের হার বেশি। কখনো কখনো প্রাণঘাতী রূপও ধারণ করে এ রোগ। সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে জলবসন্তে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে মারাও যাচ্ছেন অনেক রোগী। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে রোগটির গতিপ্রকৃতি, আক্রান্ত ও মৃত্যুর বিষয় যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না। ভাইরাস ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। সঠিকভাবে গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা না হলে ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে রোগটি।
ভাইরাস ও রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভেরিসেলা-জোস্টার ভাইরাস (ভিজেডভি) থেকে সৃষ্ট জলবসন্ত অত্যন্ত সংক্রামক ও ছোঁয়াচে রোগ। মূলত গরম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে অস্বস্তিকর পরিবেশ বা শুকনো আবহাওয়া থাকে তাতে এ রোগের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। যেকোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। এ রোগ প্রাণঘাতীও হতে পারে।
চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশের কোথায় কতজন অতিসংক্রামক রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছে ও মারা গেছে তার হিসাব কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের কাছে নেই। নেই রোগের গতিপ্রকৃতির বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণও। বিষয়টিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ শাখা। তাদের সঙ্গে গত তিন কার্যদিবসে যোগাযোগ করা হলেও সঠিক তথ্য মেলেনি।
রাজধানীর ‘সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল’ সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। সরকারের এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বলছে, চলতি বছর দেড় শতাধিক জলবসন্তের রোগী ভর্তি হয়েছে। আর মারা গেছে আটজন। গতকালও ১৬ জন রোগী ভর্তি ছিল। এর মধ্যে ১০ জন শিশু ও ছয়জন প্রাপ্তবয়স্ক। গড়ে দৈনিক ২০-৩০ জন রোগী জরুরি ও বহির্বিভাগে জলবসন্তে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছে। এর মধ্যে যাদের জটিলতা রয়েছে ও সংকটাপন্ন অবস্থা, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। বেশির ভাগ রোগীকে ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে এ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। ভর্তি রোগীর প্রতি ১০ জনের আটজনই শিশু। এর মধ্যে নবজাতকও রয়েছে। সাধারণত এ রোগে মৃত্যুহার খুব বেশি নয় বলে বিষয়টি সবসময়ই পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকে। এ রোগের টিকাও রয়েছে। তবে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) নিয়মিত টিকা কার্যক্রমের মধ্যে নেই।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ডা. মো. আরিফুল বাসার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বছর জলবসন্তের সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই শিশু ও নবজাতক। আমাদের এ হাসপাতাল রেফারেল সেন্টার হওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীদের পাঠানো হয়। যাদের দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা যেমন কিডনি জটিলতা, হূদরোগ, ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।’
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় জলবসন্তে আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত মার্চের শেষে ঠাকুরগাঁওয়ে দুজন জলবসন্ত রোগী মারা গেছে। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় জানিয়েছে, জেলার হরিপুর উপজেলার বনগাঁ ও কিসমত গ্রাম এবং রানীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে জলবসন্তের রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে হরিপুরের কিসমত গ্রামের ত্রিশোর্ধ্ব দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়কে জানানো হয়েছে বলে জানান ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমরা বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়ে নিশ্চিত হয়েছি। ওইসব অঞ্চলে আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কাজ করছেন।’
হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হরিপুরের কিসমত গ্রামের যে দুজন জলবসন্তে মারা গেছে তারা হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। একজনের দাফনের পর আমরা জানতে পারি। ওই এলাকায় আরো অনেকে জলবসন্তে আক্রান্ত হয়েছে। তারা কেউই হাসপাতালে আসেনি। আমরা তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।’
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. রকিবুল আলম জানিয়েছেন, তার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন জলবসন্ত রোগীর মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া ওই রোগী জলবসন্ত ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিল। তার বাড়ি হরিপুর গ্রামে। এ গ্রামের আরো একজনের মৃত্যু হয় দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
জলবসন্ত সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, রোগটি খুবই ছোঁয়াচে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম তাদের শরীরে ছড়ানোর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। জলবসন্ত গুরুতর, প্রাণঘাতীও হতে পারে। বিশেষ করে শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক, গর্ভবতী ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে জলবসন্ত ভয়াবহ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, জলবসন্ত ভিজেডভি থেকে সৃষ্ট অতিসংক্রামক একটি রোগ। ভিজেডভির শুধু একটি সেরোটাইপ জানা যায়। মানুষই এ ভাইরাসের একমাত্র বাহক। সংক্রমণের পর ভাইরাসটি নিউরাল গ্যাংলিয়ায় (স্নায়ুতন্ত্র) লুকিয়ে থাকে। ১০ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুনরায় সক্রিয় হয়। ভিজেডভি সংক্রমণ লালার ফোঁটা, রেসপিরেটরি অ্যারোসল বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সরাসরি শরীরে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের আবহাওয়ায় ১০ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে জলবসন্ত বেশি সংক্রমণ ঘটায়। এ ব্যাধিতে চুলকানি, মাথা-মুখসহ শরীরে বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি, ফোসকা, প্রাথমিকভাবে জ্বর ও অস্থিরতা দেখা যায়। রোগ-পরবর্তী নিউমোনিয়াও হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও দেশের শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ভাইরাস সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। ভাইরাসটি রক্তে গিয়ে সারা শরীরে চামড়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং চুলকানি ও ফোসকার সৃষ্টি করে। মানুষের শরীরেই এ ভাইরাসের জন্ম এবং মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। একটা সময় জলবসন্তের ওষুধ ছিল না। এখন ওষুধ রয়েছে, টিকাও রয়েছে। যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। জলবসন্ত-পরবর্তী নিউমোনিয়া ভয়ানক আকার ধারণ করতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস, হূদরোগসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে তাদের জন্য জলবসন্ত প্রাণঘাতী হতে পারে।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে জলবসন্তের রোগীদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের মজুদ নেই বলে জানা গেছে। ১২ এপ্রিল সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, জটিলতাসহ চিকেন পক্সে আক্রান্তদের উন্নত চিকিৎসার জন্য অ্যাসিক্লোভির ইনজেকশন ৫০০ এমজি ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। তবে হাসপাতালের ভাণ্ডারে ওষুধটির মজুদ নেই। ফলে ভর্তীকৃত জলবসন্ত আক্রান্ত জটিল রোগীদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। কোনো সরকারি, বিশেষায়িত, জেলা হাসপাতালে অতিরিক্ত মজুদ বা অব্যবহূত থাকলে চিকিৎসাসেবার স্বার্থে তা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে সরবরাহের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিশুদের রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা সাধারণত কম থাকে। থ্যালাসেমিয়া, লিউকেমিয়ায় (রক্ত বা অস্থিমজ্জায় ক্যান্সার) আক্রান্তদের জলবসন্ত হলে মৃত্যুহার বেশি। জলবসন্ত নিউমোনিয়া সৃষ্টি করে। জলবসন্তে আক্রান্তরা শুরুতে চিকিৎসকের কাছে আসে না। জটিলতা সৃষ্টি হলে হাসপাতালে আসে। এ সময় চিকিৎসা জটিল হয়।’
ওষুধের মজুদ না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যাসিক্লোভির ইনজেকশন কেনে। আমরা কিনি। এ বছর রোগী বেশি হওয়ায় মজুদ শেষ হয়ে গেছে। প্রাপ্তবয়স্কদের তিনবেলা পাঁচদিন এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ডোজ দেয়া হয়। ওষুধটি পেতে আমরা চিঠি দিয়েছি।’
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্য জানা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. শাহ আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো রোগের আউটব্রেক না হলে আইইডিসিআর কনসার্ন হয় না। কোনো উপজেলায় যদি তিন-চারজন মারা যায় তবেই আইইডিসিআর সেখানে যায়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলার স্বাস্থ্য বিভাগকে বিষয়টি আমাদের অবহিত করতে হয়। তবে জলবসন্তের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা জানতে পারে।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায় গত তিন কার্যদিবস যোগাযোগ করা হয়। কথা বলা হয় এ শাখার পরিচালক ডা. মো. নাজমুল ইসলামের সঙ্গে। তবে সারা দেশে জলবসন্ত নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের কোনো চিত্রই তিনি জানাতে পারেননি।