মানবদেহের হৃদযন্ত্রের ভালভের কাজ হলো রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখা। কোনো কারণে ভালভ অকেজো হয়ে পড়লে অকার্যকর হয়ে পড়ে শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ হৃদযন্ত্র। তখন কৃত্রিম ভালভ লাগানোর মাধ্যমে স্বাভাবিক রাখা হয় হৃদযন্ত্র। অস্ত্রোপচারটি বেশ জটিল হলেও বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষকে এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশে প্রতিদিন কতটি ভালভ প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচার হয় তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। হৃদযন্ত্রে প্রতিস্থাপিত কৃত্রিম ভালভ ও অস্ত্রোপচারে ব্যবহূত অক্সিজেনেটর দেশে তৈরি হয় না, এটি পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও এর কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি মেডিকেল ডিভাইস আমদানিতে সংকট তৈরি হয়েছে, যার কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ চিকিৎসার জন্য রোগীদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে, যা বাড়াচ্ছে মৃত্যুঝুঁকি।
দেশের যে হাসপাতালগুলোতে সবচেয়ে বেশি হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচার হয় তার মধ্যে অন্যতম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিভিডি)। সরকারি এ হাসপাতালে প্রতি মাসে গড়ে ১০০টির বেশি ভালভ প্রয়োজন হয়। কিন্তু চার মাস ধরে সরবরাহের পরিমাণ ৫০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে অক্সিজেনেটর ও ভালভ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জবাব চেয়ে চিঠি দিয়েছে এনআইসিভিডি কর্তৃপক্ষ। ১৪ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির কার্ডিয়াক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. একেএম মনজুরুল আলম স্বাক্ষরিত ওই চিঠি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাঠানো হয়। পর্যাপ্তসংখ্যক ডিভাইস সরবরাহে কেন ঘাটতি হচ্ছে তা চিঠি ইস্যুর তিন কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ইউনিমেড লিমিটেড, দ্য স্পন্দন লিমিটেড, ভিশন মেডিটেক লিমিটেড ও কার্ডিওহেল্প লিমিটেড—এ চার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অক্সিজেনেটর ও ভালভ সরবরাহ করে। প্রতি মাসে শতাধিক ভালভ প্রয়োজন হলেও চলতি মাসে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভালভের সরবরাহ নেই। চার মাস ধরে সরবরাহ ৫০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছে। অন্যদিকে অক্সিজেনেটরের চাহিদা ভালভের চেয়ে তিন গুণ হলেও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। এনআইসিভিডি দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে পেস মেকার, হার্ট ভালভ, স্টেন্ট ও অক্সিজেনেটর সংগ্রহ করে। কিন্তু সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী হৃদযন্ত্রের ভালভ ও অক্সিজেনেটর সরবরাহ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।
এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা সংকটের মধ্যেও চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ দিয়েছি। তাদের লিখিতভাবে কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হার্টের ভালভ সাধারণত ২৫-৩৩ মিলিমিটারের মধ্যে চারটি আকারের হয়। টিস্যু ও মেটালিক দুই ধরনের ভালভ মানুষের হার্টে লাগানো হয়। রোগীর বয়স, অবস্থা বিবেচনায় ভালভের আকার ও প্রকার নির্ধারণ করা হয়। বছরে সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার হার্টের ভালভের চাহিদা রয়েছে। আর অক্সিজেনেটরের চাহিদা রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার।
অক্সিজেনেটর ও ভালভ সরবরাহকারী অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হার্টের ভালভ ও অক্সিজেনেটর আমদানি করা হয় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসব ডিভাইস তৈরির কাঁচামাল বেলারুশ, ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাঁচামাল সংগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয়সংখ্যক ডিভাইস উৎপাদন করতে পারছে না। একই সঙ্গে করোনা মহামারীর কারণে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বহু কর্মী ছাঁটাই করেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না।
হৃদযন্ত্রের ভালভ সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, মেডিকেল ডিভাইস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবারই অনেক আগে থেকে চার-পাঁচটি লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা রয়েছে। তবে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ করতে পারছে না। হার্টের ভালভের কাঁচামালের মধ্যে পাইরোলেটিক কার্বন অন্যতম। রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশে উত্কৃষ্ট পাইরোলেটিক কার্বন পাওয়া যায়। ওইসব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অন্যান্য দেশের ভালভ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান পাইরোলেটিক কার্বন সংগ্রহ করে। তবে বর্তমানে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ শতাংশের বেশি কাজে আসছে না। চাহিদা ও উৎপাদনে ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও ডলার সংকট আমদানিতে প্রভাব ফেলেছে। স্বাস্থ্যগত বিষয়ে এলসি খোলা গেলেও তাতে জটিলতা রয়েছে। জটিলতাগুলো এড়িয়ে এলসি করা গেলেও যেহেতু চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না তাই স্বাভাবিকভাবেই সংকট দেখা দিয়েছে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স বৃদ্ধি, উচ্চরক্তচাপ ও দীর্ঘমেয়াদি বাতরোগ থাকলে সাধারণত ভালভ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। আর অক্সিজেনেটর হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচারে জরুরি। সাধারণত বয়স্ক ও শিশুদের পেটেন্ট ডাক্টাস আর্টেরিওসাস (পিডিএ) ও অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (এএসডি) অস্ত্রোপচার বাদে হৃদযন্ত্রের সব ধরনের অস্ত্রোপচারে অক্সিজেনেটর প্রয়োজন হয়। হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচারের সময় একজন রোগীর রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখতে কৃত্রিম ফুসফুসের মতো রক্ত সঞ্চালন করে অক্সিজেনেটর। অক্সিজেনেটর কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে ও ধমনীতে পাম্প করা রক্তে অক্সিজেন যোগ করে। বেশির ভাগ সময় অ্যারোটিক ও মাইট্রাল ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন আমদানিককারক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ৫০ হাজার ভালভের জন্য ক্রয়াদেশ দিয়ে রেখেছে। তবে তারাও সরবরাহ পাচ্ছে না। বাংলাদেশে যেসব হাসপাতালে হার্টের ভালভ লাগানো হয় সেসব হাসপাতাল ভালভ পাচ্ছে না। ভালভের চেয়ে তিন গুণ বেশি প্রয়োজন হয় অক্সিজেনেটরের। ভালভের সার্জারি ছাড়াও প্রায় সব ধরনের ওপেন হার্ট সার্জারিতে অক্সিজেনেটর প্রয়োজন হয়। তবে এ সংকট কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দোষে হয়নি। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিই এ সংকট সৃষ্টি করেছে। দেশের প্রায় সব হাসপাতালেই এখন সংকট চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, হৃদযন্ত্রের ভালভের সংকটের কথা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এনআইসিভিডি কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।