২৫ শতাংশ নবজাতকের জন্ম হচ্ছে অদক্ষ হাতে

বাংলাদেশে এখনো জন্মের এক মাসের মধ্যে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে ১৫টি মারা যায়। এরপর জন্মের এক বছরের মধ্যে মারা যায় ২২টি, আর পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায় ২৮টি শিশু। জন্মের সময় সঠিকভাবে সেবা পেলে নবজাতক ও শিশু মৃত্যুহার আরো কম থাকত। এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির হাতে নবজাতকের জন্ম।

বাংলাদেশ জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে ২৫ শতাংশের জন্ম হয়েছে বাড়িতে অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির হাতে। প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাবেই এমন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে শিশুমৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মাতৃমৃত্যুর শঙ্কা। নবজাতকের জন্মের আগে ও পরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে বলে জানিয়েছেন মা ও শিশু স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ শিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশুর জন্ম হচ্ছে বাড়িতে। সরকারের সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, বছরে ৫০ শতাংশ নবজাতকের জন্ম হয় বাড়িতে, ১৪ শতাংশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, ৩২ শতাংশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এবং ৪ শতাংশের জন্ম হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সুবিধাসংবলিত প্রতিষ্ঠানে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, গত বছর সারা দেশে বাড়িতে ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯২টি নবজাতকের জন্ম হয়। এর মধ্যে চার লাখ নবজাতকের জন্ম হয় প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মীর হাতে। বাকি ১ লাখ ৩৬ হাজার ৮৬৪ নবজাতকের জন্ম হয় নিজ বাড়িতে অদক্ষ ব্যক্তিদের হাতে। এ তথ্য শুধু ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে তাদের মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য সহকারীদের দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ করেছে অধিদপ্তর।

সারা দেশে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রসূতিদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। প্রসূতিবিদ্যায় অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রাতিষ্ঠানিক বা বাড়িতে গিয়ে সেবা দেন।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে চিকিৎসক, নার্স, ধাত্রী বা মিডওয়াইফ, কমিউিনিটি সেইফ বার্থ অ্যাটেনডেন্ট, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক ও বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মীদের বাইরে অদক্ষ লোকবলের হাতে জন্ম নিয়েছে ২৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বাড়িতে জন্ম নেয়া নবজাতকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অদক্ষ হাতে হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। অদক্ষ হাতে জন্ম নেয়া নবজাতকের মধ্যে ৩১ শতাংশই হয়েছে এ বিভাগে। এরপর সিলেট বিভাগে ১৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১২, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ শতাংশ করে, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে ৬ শতাংশ করে এবং রংপুর বিভাগে বাড়িতে অদক্ষ হাতে জন্ম নিয়েছে ৫ শতাংশ নবজাতক।

দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছেন জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক সুব্রত কুমার চৌধুরী। তিনি সম্প্রতি অবসরপূর্ব ছুটিতে গিয়েছেন। তার মতে, গ্রামীণ পর্যায়ে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকবলের ঘাটতি অনেক বেশি। চট্টগ্রাম জেলায় উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রসূতিদের সেবা দেয়ার জন্য পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ পদ খালি। এমনই চিত্র অন্যান্য কার্যালয়েরও। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। তবে সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেবা দেয়ার জন্য লোকবল না বাড়ালে কোনো অগ্রগতি হবে না।

মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর জন্য সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ লোকবলের সংকটকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশিক্ষিত লোকবল না থাকায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বা সি-সেকশন করে বাচ্চা জন্মদানে প্রসূতি ও তার পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করছে। নবজাতক মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে জন্মের সময় শ্বাসরুদ্ধ হওয়া, জীবাণুর বিষক্রিয়ায় পচন ও সংক্রামক রোগ। এসবের বেশির ভাগ ঘটে অদক্ষ হাতে জন্ম নেয়া নবজাতকের ক্ষেত্রে।

গাইনোকোলোজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, অদক্ষ হাতে প্রসবের ক্ষেত্রে অনেক ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। সাধারণত ১০০টি স্বাভাবিক প্রসবের মধ্যে ২০টি জটিল হয়। এসব যদি দক্ষ হাতে না হয়, তাহলে নবজাতক ও মাতৃমৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে। অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তিরা সংক্রমণ সম্পর্কে জানেন না। তারা হাতে গ্লাভস না পরে প্রসব করানোর কাজ করেন। একই সঙ্গে প্রসূতির উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে খিচুনি হয়, একলামপসিয়ার সৃষ্টি হয়। এমন হলে সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিতে হবে। বিষয়টি অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তিরা বুঝতে পারে না। একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় নবজাতক মায়ের যোনিপথে আটকে থাকলে তাতে মা ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া পরে মায়ের ফিস্টুলার সমস্যা হতে পারে। প্রসবকাল মা ও শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিধায় প্রতিটি মুহূর্তে দক্ষতার বিকল্প নেই।

মাতৃমৃত্যুর জন্য বেশকিছু কারণ রয়েছে উল্লেখ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা) ডা. মো. মাহামুদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, অদক্ষ ব্যক্তির হাতে প্রসব হলে প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত থেকে বেশকিছু জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের দেশে লোকবলের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও নগরে স্থানীয় সরকার বিভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। ওষুধ ও অবকাঠামোর কোনো ঘাটতি না থাকলেও লোকবলের সংকট বেশি। সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ধাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. নাসির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা আরো পাঁচ হাজার ধাত্রী পদ সৃষ্টি করেছি। এতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অনুমোদনও দিয়েছে। যে ৪০০ পদ ফাঁকা রয়েছে, তাতে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। নার্সদের জন্য নতুন অর্গানোগ্রাম করা হয়েছে। এরপর আমরা আরো ১০ হাজার নার্স নিয়োগ দিতে পারব।

Source: Bonik Barta

Share the Post: