৮ বিভাগে রোগ নির্ণয় ব্যবস্থার আধুনিকায়ন: প্রকল্প মেয়াদের ছয় বছরে কাজ হয়নি ১ শতাংশও

উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতে দেশের আট বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ধরনের রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা আধুনিক করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় সরকারের এ কার্যক্রমের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি প্রকল্প মেয়াদের ছয় অর্থবছরে কাজ হয়নি ১ শতাংশও। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন (কম্পোনেন্ট-২: দেশের আটটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক ইমেজিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ) শীর্ষক প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পটির জন্য ২০১৬ সালের ২১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৯০০ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে সরকারের কোষাগার থেকে ১৯৭ কোটি টাকা দেয়ার কথা এবং ৭০৩ কোটি টাকার ঋণসহায়তা দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও কোনো কাজ শুরু হয়নি। এতে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ২০১৬-১৭ থেকে পরবর্তী ছয় অর্থবছর প্রকল্পটির বিপরীতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ৮৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে ব্যয় হয় মাত্র ২৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

জানা যায়, ব্যয়ের প্রায় পুরোটাই গিয়েছে প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে। অবকাঠামোগত দৃশ্যমান তেমন কোনো কাজ হয়নি। একমাত্র ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামোর নির্মাণ চলমান রয়েছে। এ হাসপাতালে কাজের অগ্রগতি মাত্র ১৮ শতাংশ। বাকি পুরো প্রকল্পের কাজে ১ শতাংশও বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে বলা হয়, জাইকার অর্থায়নে কনসালট্যান্ট ফার্ম নিয়োগে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) আহ্বানে জাইকার সম্মতি, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নেয়া হয়। পরে ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর কনসালট্যান্ট সার্ভিস ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। যদিও ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে ফার্ম।

সরকারি অর্থায়নে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্যক্রম চলমান থাকলেও বাকি সাত বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভৌত অবকাঠামোর কোনো কাজই হয়নি। জাইকার অর্থায়নে ডায়াগনস্টিক ইমেজিং ভবনের জন্য জায়গা নির্ধারণ, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত, সাইটের টপোগ্রাফিক সার্ভে ও সয়েল টেস্ট সম্পন্ন, নকশা ও খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে। এসব ভবন নির্মাণ দরপত্রের চুক্তিপত্র সম্পন্ন হয় গত ৭ মার্চ। চুক্তিপত্রে জাইকার চূড়ান্ত অনুমোদন মেলে ২৪ মে। এরপর ২৫ মে কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য এরই মধ্যে নথিপত্র প্রস্তুত করে জাইকার সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে।

যদিও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. সাইদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন কারণে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। এখন সব প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে। প্রকল্পের দায়িত্ব পালনকারীরা আন্তরিক রয়েছেন। আমরা আশা করি বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে জাইকার সঙ্গে ২০১৫ সালের ঋণ চুক্তি হলেও পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ বিভাগ সৃষ্টি হওয়ায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্ত করার শর্তে প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ২১ জুলাই একনেকে অনুমোদন হয়। পরিকল্পনা কমিশন ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর সংশোধিত প্রকল্প পরিকল্পনার অনুমোদন করে। অর্থাৎ ময়মনসিংহকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন আদেশ জারি হতে প্রায় দেড় বছর সময় চলে যায়।

এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে দেরি হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার কারণে প্রকল্পে নিয়োজিত জাপানের নাগরিকরা বাংলাদেশ থেকে চলে যান। জাইকার ঋণ চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণকাজ তদারক করতে গণপূর্ত অধিদপ্তর অপারগতা প্রকাশ করে। পরে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে তদারক করার বিষয়ে যুক্ত করতেও ছয় মাসের মতো সময় লাগে। কনসালট্যান্ট ফার্ম নিয়োগে তিন বছর সময় ব্যয় হয়। এছাড়া করোনা মহামারীকে বিলম্বের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে শুরুতে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পরবর্তী সময়ে সেখানে পাঁচ হাজার শয্যার নতুন প্রকল্প শুরু হয়। এতে এ হাসপাতালকে বাদ দিয়ে ঢাকা বিভাগের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ হাসপাতালে প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় করার কথা থাকলেও কক্ষ বরাদ্দ দেয়া হয়নি, এমনটি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বণিক বার্তাকে জানান, প্রকল্পের পরিচালকের কার্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত এপ্রিলেই উদ্বোধনের কথা থাকলেও প্রকল্পের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেননি।

শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প (কম্পোনেন্ট-২) পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন-আল-আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডায়াগনস্টিক ইমেজিং ভবনের জন্য কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে প্রায় ১৮ শতাংশ কাজ করা হয়েছে। বাকি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো ভৌত অবকাঠামোর কাজ শুরু হয়নি। তবে আমাদের সব প্রস্তুতি শেষ। জাইকা অর্থ ছাড় করলেই আমরা কাজ শুরু করতে পারব। যদিও ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হলেও সে সময়ের মধ্যে প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারার সম্ভাবনা কম। আরো এক বছর সময় লেগে যেতে পারে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: