চিকিৎসাবিজ্ঞানে অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার বড় আশীর্বাদ। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। কোনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে পুরোপুরিভাবে রেজিস্ট্যান্স (প্রতিরোধ) গড়ে তুলেছে জীবাণুরা। এই রেজিস্ট্যান্স বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ। মহামারী মোকাবেলায় সাফল্য থাকলেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে পিছিয়ে রয়েছে বিশ্ব। হুমকির মুখে পড়েছে সংক্রামক রোগের চিকিৎসা। বাংলাদেশে টাইফয়েড, শিশুদের রক্ত আমাশয় জীবাণুরোধী ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে জীবাণুরা। মানবদেহ ছাড়াও অ্যান্টিবায়োটিকের বহুগুণ প্রয়োগ হচ্ছে কৃষি উৎপাদন ও পশুপালনে।
নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, রক্তের বিষক্রিয়া, গনোরিয়া, রক্ত আমাশয় ও খাদ্যজনিত রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমেছে বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলছে, এতে চিকিৎসা কঠিন ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই মানবদেহে ও কৃষিতে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। কোনো কোনো চিকিৎসক নীতিমালা ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন। পোস্ট অ্যান্টিবায়োটিকের (অ্যান্টিবায়োটিক-পরবর্তী সময়) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। ফলে সাধারণ সংক্রমণ ও ছোটখাটো আঘাত মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সও (এএমআর) বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ। মানুষ, কৃষি, পশু ও প্রকৃতিতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এই রেজিস্ট্যান্স তৈরির জন্য দায়ী। নিম্ন ও মধ্যমআয়ের দেশগুলোয় অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধের (ওটিসি) বা ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রির ব্যবস্থার অপব্যবহার, কম জৈবনিরাপত্তা ও অনিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা অতিমাত্রায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যবহারের জন্য প্রভাব ফেলছে। ব্যাকটেরিয়া প্রাণী (জুনোটিক ব্যাকটেরিয়া) থেকে মানুষের মধ্যে সরাসরি বা খাদ্য ও পানিদূষণের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
গত মাসে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা এমডিপিআইয়ের জার্নাল অ্যান্টিবায়োটিকসে প্রকাশিত ‘মাইক্রোবিয়াল কন্টামিনেশন অ্যান্ড অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ইন মার্কেটেড ফুড ইন বাংলাদেশ: কারেন্ট সিচুয়েশন অ্যান্ড পসিবল ইমপ্রুভমেন্টস’ গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের বাজারের টমেটো, মাছ ও মুরগিতে টাইফয়েড, নিউমোনিয়া ও করেলার ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। নিরাপদ খাদ্যের সরবরাহে যথাযথ নজরদারির অভাবে এএমআর বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রাজধানী, সাভার ও নেত্রকোনার ৮৫৩ বিক্রয় কেন্দ্র (বাজার ও সুপারমার্কেট) থেকে প্রায় এক হাজার নমুনা নিয়ে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। এসবের মধ্যে ৬১৫টিতে দুটি এবং ৩৫৯ ও ৩২০টিতে একটি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। মাছের মধ্যে ই. কোলাই ও ভিব্রিও কলেরি, টমেটোতে সালমোনেলা ও ই. কোলাই এবং মুরগির মধ্যে পাওয়া গেছে সালমোনেলা। টমেটোতে সালমোনেলা ৭ শতাংশ আর ই. কোলাই পাওয়া যায় ১৪ শতাংশ। মুরগিতে সালমোনেলা ১৭ শতাংশ। মাছের নমুনার ২৭ শতাংশের ক্ষেত্রে ই. কোলাই এবং ৪৫ শতাংশের ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে ভিব্রিও কলেরি বা কলেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, ই. কোলেই ব্যাকটেরিয়া পরিবেশ, খাবার, মানুষ ও প্রাণীর অন্ত্রে পাওয়া যায়। এর কারণে ডায়রিয়া, মূত্রনালির সংক্রমণ, শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। ভিব্রিও কলেরি একটি বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া যা তীব্র ডায়রিয়াজনিত রোগ ও অন্ত্রের সংক্রমণের কারণ। সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন প্রাণীর অন্ত্রে থাকে। টাইফয়েড এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। এতে মানুষ ও প্রাণীকে অসুস্থ করতে পারে।
মাছ, মুরগি ও টমেটোর নমুনার মধ্যে অ্যামোক্সিসিলিন ও ক্লাভুল্যানিক অ্যাসিড (এএমসি), সেফিক্সাইম (সিএফএম), সেফট্রিয়াক্সোন (সিআরও), ক্লোরামফেনিকল (সি), এজিথ্রোমাইসিন (ই), জেন্টামাইসিন (সিএন), স্টেপ্টোমাইসিন (এস), পেনিসিলিন জি (পি), টেট্রাসাইক্লিন (টিইটি), সালফামেথক্সাজোল ও ট্রাইমেথোপ্রিম (এসএক্সটি) ও নালিডিক্সিক অ্যাসিড (এনএ) অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। জীবাণুরা এসব অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
তিন ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে থাকে। মাছকে যেসব খাবার দেয়া তার মধ্যেই এসব ব্যাকটেরিয়া থাকে। পোলট্রি ক্ষেত্রেও পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখলে সালমোনেলা সংক্রমিত হয়। মুরগি, মাছ ও টমেটোর ক্ষেত্রে গবেষণায় উল্লিখিত ১১টি অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের রান্নার পদ্ধতিতে রান্নার পর এসব ব্যাকটেরিয়া থাকে না। রেজিট্যান্স প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। পেনিসিলিন আবিষ্কারের আগেই পেনিসিলিন রেজিস্ট্যান্স হয়েছিল। তবে রেজিস্ট্যান্সের মাত্রাটা যত কমিয়ে রাখা যায় ততটা মানব বা প্রাণীর স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভালো।
দেশে যেসব খাদ্য বেশি খাওয়া হয় তার মধ্যে টমেটো, মাছ ও মুরগি অন্যতম। এসব খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়গুলো কম আলোচনা করা হয়েছে। পরিবেশের এএমআর থাকার সঙ্গে অতিমাত্রায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যবহার এএমআর গড়ে ওঠার কারণ। মানুষ, পশুর পাশাপাশি কৃষি খাতে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহারের বিষয়টি খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি বা ওটিসিতে (আউট অব কাউন্টার ড্রাগ) অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রয়, সচেতনতার অভাব ও অপর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে এএমআর গড়ে উঠছে।
গত জুনে ল্যানসেট মাইক্রোবিয়াল সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘দি ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ইন্টারকন্টিনেন্টাল স্প্রেড অ্যান্ড এক্সপানসন অব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স স্যালমোনেলা টাইফি: আ জিনোমিক এপিডেমিওলজি স্টাডি’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী স্ট্রেইন তৈরি করছে। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী এ স্ট্রেইন ৩০ বছর ধরে অন্তত কয়েকশ বার দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল থেকে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া দেখা যাচ্ছে।
সালমোনেলার কারণে টাইফয়েডের সৃষ্টি হয়। এর টিকা দেশে প্রয়োগ হয়। আর কলেরার টিকা আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি), বাংলাদেশ প্রয়োগ শুরু করেছে। ই. কোলাইয়ের কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। এর বহু ধরন রয়েছে। এর মধ্যে ই. কোলাই মারাত্মক। কেননা শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটায় ই. কোলাই। প্রকৃতিতে থাকা এসব ব্যাকটেরিয়া মাছ, মুরগি ও টমেটোতে আসা অস্বাভাবিক নয়। রান্নার ফলে পরও সব জীবাণু মারা যায় না। ২০০৭ সালে ডব্লিউএইচও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের অতিব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। দেশে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিনের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে।
শিশুদের মধ্যে রক্ত আমাশয়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের প্রথম পর্যায়ের ওষুধ হলো সিপ্রোফ্লক্সাসিন। দ্বিতীয় সারির ওষুধ হলো মেসিলিনাম ও সেফট্রিয়াক্সোন। অ্যাজিথ্রোমাইসিন শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের ওষুধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। শিশুদের রক্ত আমাশয় সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন প্রতিরোধী হয়ে ওঠায় তা বহু ওষুধবিরোধী বা মাল্ট্রি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্সের সৃষ্টি হয়েছে বলেছে আইসিডিডিআর,বি।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা রয়েছে। অণুজীব, ভাইরাস, ছত্রাক, পরজীবী প্রতিনিয়ত রূপ পাল্টায়। অণুজীব ধ্বংস করার ক্ষেত্রে প্রয়োগকৃত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে জীবাণুরা। জীবাণুগুলো ধীরে ধীরে এএমআর গড়ে তোলে। ২০ বছর আগে শিগেলা ব্যাকটেরিয়া যে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করত, ২০ বছর পর এসে তা প্রতিরোধ করছে। শিগেলা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধী হয়ে ওঠায় হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এএমআর প্রতিরোধের তীব্রতা দ্রুত কমানো না গেলে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাবে।
এএমআরের ক্ষেত্রে মানবদেহে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালসের অপপ্রয়োগের বাইরেও বড় কারণ রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দুর্বল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পর তা সহজেই প্রকৃতিতে চলে আসে। প্রকৃতিতে যে ব্যাকটেরিয়া রয়েছে তাতে ওই সামান্য অ্যান্টিবায়োটিকে ধ্বংস হয় না। বিপরীতে অ্যান্টিবায়োটিকের সংস্পর্শে এসে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। জীবাণুর জিন ওষুধের বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালী হয়ে যায়। ব্যবস্থাপনার অভাবে চিকিৎসা বর্জ্য, ওষুধ কারখানার বর্জ্যগুলো প্রকৃতিতে যাচ্ছে। তা গাছের মাধ্যমে ফলে যায়, ঘাস পশুরা খায়, মাছে খায় ও সেগুলো মানুষের পেটে আসে। প্রাণিদেহে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ হচ্ছে। তাদের মাংস খাওয়ার ফলে মানুষের শরীরেও রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়েছে। যেসব অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে তার প্রায় সবই প্রতিরোধের মুখোমুখি।
ডব্লিউএইচও ঘোষিত ওয়ান হেলথের (মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের ভারসাম্য ও উন্নতির এক সমন্বিত ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা) চক্রটি সবাইকে বুঝতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক প্রয়োগ না হলে তা মাটি বা পানিতে গিয়ে মাছ বা বিভিন্ন পোকা-মাকড়ের মাধ্যমে মুরগি বা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে গিয়ে আবার মানুষের পেটে ফিরে আসে। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক থাকা মাটির গাছের ফল খেলেও তা মানুষের মধ্যে চলে আসে। চক্রটি ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব সংস্থা জড়িত তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। শুধু ওষুধ ও চিকিৎসকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। এএমআর প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেমন—স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের সমন্বয় জরুরি।