ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা এবং ওষুধ শিল্পের প্রবৃদ্ধি স্থানীয় ওষুধের বাজারকে করেছে সমৃদ্ধ। বৈশ্বিক বাজারেও অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় এখন ওষুধের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক বাংলাদেশ। প্রতি বছরই বিশ্ববাজারে রফতানির এ আকার বড় হচ্ছে। একই মানের হওয়া সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের ফার্মাসিউটিক্যালসে প্রস্তুতকৃত ওষুধের চেয়ে কম দাম, যা রফতানিতে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। যদিও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের চিত্র ঠিক এমনটি ছিল না। এদেশে ওষুধ শিল্পের প্রসার ঘটে মূলত আশির দশকে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের যাত্রা শুরু পঞ্চাশের দশকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে এ শিল্পের পরিধি। বর্তমানে সারা দেশে ২৯৫টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে প্রায় ৪৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল। এছাড়া দেশের ২৮৪টি ইউনানি ও ২০৫টি আয়ুর্বেদিক, ৭১টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩১টি হার্বাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন করছে।
জানা যায়, সরকার ১৯৭৪ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করে ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তর। তারও আগে ১৯৭৩ সালে প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানি করার জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের অধীনে গঠন করা হয়েছিল একটি সেল। এককথায় স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশে ওষুধের স্থানীয় বাজার প্রায় পুরোটাই বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যালসের দখলে ছিল। এ সুযোগে অধিক বা অনৈতিক মুনাফা করার সুযোগ নিতে শুরু করে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী। তাদের রুখতে সরকার ১৯৮২ সালে প্রণয়ন করে ড্রাগ (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স বা ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, যেখানে দেশী ওষুধ শিল্পের বিকাশে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ট্যাবলেট, ইনজেকটেবল, ক্যাপসুল, অ্যান্টিবায়োটিকের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে তালিকা করে দেড় হাজারেরও বেশি ওষুধ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। জাতীয় এ ওষুধনীতিতে বলা হয়েছিল, যেসব ওষুধ দেশী কোম্পানিগুলো তৈরি করতে পারে, সেগুলো আমদানি করা যাবে না। আর এসব পদক্ষেপই পর্যায়ক্রমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প। ১৫০টি ওষুধকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বাধ্যতামূলক করা হয় দেশীয় কোম্পানিগুলোর মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশ এসব ওষুধ উৎপাদনকে।
সরকারের এ নীতির ফলে বিদেশী ওষুধ কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাণিজ্য থেকে দেশীয় ওষুধ শিল্প মুক্তি পায় এবং ধীরে ধীরে বাজার সম্প্রসারণ শুরু করে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ১৯৮৫ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রফতানি শুরু করে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো।
এদিকে ১৯৮২ অর্ডিন্যান্স ও জাতীয় ওষুধ নীতি পর্যালোচনা করে ২০০৫ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় ওষুধ নীতি। ২০১০ সালে ঔষধ পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়। এ অধিদপ্তর বর্তমানে দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র লাইসেন্সিং ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। ওষুধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ওইসব অর্ডিন্যান্স ও নীতি ছাড়াও দ্য ড্রাগ অ্যাক্ট ১৯৪০, দ্য ড্রাগ রুলস ১৯৪৫ ও দ্য বাংলা ড্রাগ রুলস ১৯৪৬ এবং সরকারের বিভিন্ন সময়ে দেয়া নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানায়, দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের অন্তত ১৫৭টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও নীতির ফলে ওষুধ রফতানি ও দেশীয় বাজারের আকার প্রতিনিয়তই বড় হচ্ছে। দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ৫০টি বড় অংকের রফতানি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। এশিয়ার ৪৩টি, দক্ষিণ আমেরিকার ২৬টি, উত্তর আমেরিকার ছয়টি, আফ্রিকার ৩৯টি, ইউরোপের ৩৮টি ও অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ।
অধিদপ্তরের গত ১০ বছরের রফতানির হিসাব বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকার ওষুধ রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে রফতানি হয় ৬১৯ কোটি টাকার। এরপর ২০১৪ সালে ৭৩৩ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে ৮০০ কোটি, ২০১৬ সালে ২ হাজার ২৪৭ কোটি, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ১৯৬ কোটি, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৫১৪ কোটি, ২০১৯ সালে ৪ হাজার কোটি, ২০২০ সালে ৪ হাজার ১৫ কোটি, ২০২১ সালে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি ও ২০২২ সালে ৬ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকার ওষুধপণ্য রফতানি করেছে দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের রফতানি ক্রমান্বয়ে বাড়লেও সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে করোনা মহামারীতে। এ সময় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভির ও ফ্যাভিপিরাভির রফতানি বেড়ে যায়। বিভিন্ন দেশের সরকারও বাংলাদেশে ওষুধের চাহিদা পাঠায়। এ সময় এককভাবে রেমডেসিভির ওষুধ রফতানি হয়েছে অনেক বেশি। এরপর জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুত ও রফতানিতে অনুমোদন দেয় ডিজিডিএ। মান ও কম দামের পাশাপাশি দ্রুত ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালসের বেশ সুনাম।
ওষুধ শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশ্ববাজারে দেশীয় ওষুধের রফতানির আকার বছর বছর বাড়লেও প্রায় ৯০ শতাংশ ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। পাশাপাশি দেশীয় ওষুধ শিল্পে উল্লেখযোগ্য গবেষণা না থাকায় নতুন মলিকুল তৈরি করা যাচ্ছে না। এছাড়া বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে, তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পেটেন্টকৃত ওষুধ উৎপাদনে ছাড় সুবিধা হারাবে। তখন পেটেন্টকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে এবং কিছু কমপ্লেক্স বায়োলজিকস দেশে আর পাওয়া নাও যেতে পারে।
এসব বিষয় বিবেচনা করে সরকার অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্টস (এপিআই) বা সক্রিয় ঔষধি উপাদানের শিল্প পার্ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ২১৬ একর জমিতে এটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। প্রায় দেড় দশক আগে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের যদিও কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই পার্কে এরই মধ্যে ৪৪টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো নির্মাণকাজও শুরু করে দিয়েছে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে এপিআই পার্কে শিগগিরই ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। পার্কটি পরিপূর্ণভাবে চালু হলে বাংলাদেশ ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক